০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ পৌষ ১৪৩১, ৬ রজব ১৪৪৬
`

সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন
-


সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও করপোরেট হাউজগুলোর হাত থেকে সংবাদমাধ্যমকে মুক্ত রাখতে হবে। বিগত বছরে যেসব সাংবাদিকের নামে মিথ্যা মামলা হয়েছে সেগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। গত ১৫ বছরে যেসব ভুয়া পত্রিকা নিবন্ধিত হয়ে ডিএফপির তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলোকে বাদ দিতে হবে। পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগদান করতে হলে সাংবাদিকতায় কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে বা সাংবাদিকতায় পেশাগত ডিগ্রি থাকতে হবে। গতকাল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সাথে মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকরা এসব সুপারিশ তুলে ধরেন। সভায় চট্টগ্রাম বিভাগের আট জেলায় কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
এতে বক্তারা বলেন, মফস্বল সাংবাদিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে সাংবাদিক লেখা স্টিকার ব্যবহার করে ভুয়া সাংবাদিকরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে আসছে। এসব ভুয়া সাংবাদিকতা বন্ধের নিমিত্তে প্রেস ইনিস্টিটিউটে ডিপ্লোমা চালুকরণ বা সাংবাদিকদের মান উন্নয়নের জন্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাংবাদিকদের একক রেজিস্ট্রেশন নাম্বার প্রদান ও তাদের সরকারি পরিচিতি নিশ্চিত করতে হবে। ফলে একজনের একাধিকবার সরকারি সুবিধা প্রাপ্তি বন্ধ হবে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, আখতার হোসেন খান, বেগম কামরুন্নেসা হাসান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মোস্তফা সবুজ, চট্টগ্রাম পিআইডির উপ-প্রধান তথ্য অফিসার মো: সাঈদ হাসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: কামরুজ্জামানসহ বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, সংবাদপত্রকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করার জন্য এ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের প্রধান লক্ষ্য থাকবে সংবাদ প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের সম্পাদকীয় নীতিমালা নেই। সারা দেশে সম্পাদকীয় মান অভিন্ন ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড থাকা উচিত, সব প্রতিষ্ঠান মেনে চলবে ন্যূনতম সাংবাদিকতার নৈতিকতার দিকগুলো- সে রকম কোনো কিছু নেই। সেটির জন্য আমরা সম্পাদক পরিষদকে বলেছি। কমিশন প্রধান বলেন, আমাদের দেশে একই মিডিয়া হাউজকে টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন পোর্টাল, প্রিন্ট ভার্সন বা অনলাইন রেডিওর অনুমতি দেয়া হয়েছে। ফলে একই খবর ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এতে পাঠক ভিন্ন কোনো মত বা বৈচিত্র্য পাচ্ছেন না। এগুলোর সমাধান আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আপনারা আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত যঃঃঢ়ং://সৎপ.ঢ়ড়ৎঃধষ. মড়া.নফ/ এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত বা সুপারিশ কমিশনের কাছে পৌঁছাতে পারবেন। আপনাদের প্রেরিত মতামত বিবেচনা করে কিভাবে গণমাধ্যমে সংস্কার আনা যায় এ বিষয়ে কমিশন সুপারিশ পেশ করবে।
রাজনৈতিক কারণে বৈষম্যের শিকার সাংবাদিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রস্তাবে সায় দিয়ে সভায় কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘নীতিগতভাবে বা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি বা সাংবাদিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটা আমাদেরকে বিবেচনায় নিতে হবে। একইভাবে হয়রানিমূলক মামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, জেল খেটেছেন, দিনের পর দিন কাজ করতে পারেননি, তাদের মামলা প্রত্যাহারের বিষয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই বিবেচনা করা দরকার। আর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিটাও যৌক্তিক ও ন্যায্য।’

তিনি বলেন, ‘আপনাদের (সাংবাদিক) বক্তব্যে রাজনৈতিক সক্রিয়তা, দলীয় সক্রিয়তা, ফ্যাসিবাদের সহযোগিতা সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যারা ফ্যাসিবাদে সহযোগিতা করেছেন তাদের বিচারের প্রশ্ন উঠেছে। তাদের যারা উসকানি দিয়েছেন তাদের বিচারের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সমস্যা হলো আমরা কোনো তদন্ত সংস্থা নই। অপরাধগুলোর তদন্ত আমরা করতে পারব না। তবে আমরা এটা বলতে পারি, যারা উসকানিদাতা তাদের উসকানির বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হোক।’
ওয়েজবোর্ডের বদলে সাংবাদিকদের একটা ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করার প্রস্তাবের বিষয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, ‘সেটি একটা ভালো সমাধান হতে পারে যে, ন্যূনতম বেতন সারা দেশে সাংবাদিকদের জন্য থাকবে। যে শহরে খরচ বেশি, বিশেষ করে ঢাকায়- আলাদা করে একটা ভাতা বা বাড়তি বেতন দিতে হবে।
আমরা আশা করছি এই ধরনের সমাধানগুলো আমরা আপনাদের কাছ থেকেই পাবো। সেটির ভিত্তিতেই আমরা সুপারিশমালা তৈরি করব। বাস্তবায়ন সরকার করবে, সেটি আমাদের হাতে নেই। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও তাদের সুপারিশ লিখিতভাবে চেয়েছি।’ সম্পাদকদের জন্য নীতিমালা হওয়া দরকার জানিয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা সম্পাদক পরিষদকে বলেছি, একটা জাতীয় নীতিমালা হওয়া দরকার। আপনারা একটা মান নির্ধারণ করেন যে, এই ন্যূনতম মান আমাদের মেনে চলা দরকার। আশা করছি, সম্পাদক পরিষদ সেই উদ্যোগটা নেবে।’ পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদকদের যোগ্যতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে যোগ্যতার প্রশ্ন, পেশাদার সাংবাদিকের সম্পাদক হওয়ার প্রশ্ন- এগুলো কিন্তু নীতিমালায় আছে। কিন্তু আপনারাই বলছেন, উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবারের সদস্যদের সম্পাদক বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেটি আবার সরকার গ্রহণ করছে। কারণ হতে পারে রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা অন্য কিছু।’

ডিএফপি কর্তৃক পত্রিকার প্রচার সংখ্যার অবাস্তব তথ্য প্রসঙ্গে কমিশন প্রধান বলেন, ‘একইভাবে পত্রিকার প্রচার সংখ্যার দিক থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের নামেই চারটি পত্রিকার ডিক্লারেশন ছিল। একটি পত্রিকার সার্কুলেশন যেটা ছয় হাজারেরও কম, সেটি তিনি দুই লাখ ৯৯ হাজার দেখাতে বাধ্য করেছেন। এখন তো হিসাবও বেরিয়েছে ২৯৬ কোটি টাকা ওনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন করা হয়েছে। সর্বাধিক প্রচারিত যে দাবি করা হয়, হকারের বেচা-বিক্রি হিসাবে সেটিও ঠিক না।’ রাজধানীর দুটো সংবাদপত্র হকার্স সমিতিতে পত্রিকা বিক্রির পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘হকারদের পত্রিকা বিক্রির হিসাবের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। ঢাকা শহর থেকে ৩০২টি পত্রিকা মিডিয়া লিস্টে আছে, সারা দেশে ৫৯২টির মতো পত্রিকা আছে। আমরা দেখেছি হকারদের তালিকায় ৪৬টি কাগজ তারা লেনদেন করে। বাকি কাগজগুলোর কোনো পেপার (নথি) নেই। কেউ কিনে না ওই পত্রিকাগুলো। তাহলে এটা সরকারের মিডিয়া লিস্টিং-এর মধ্যে ঢুকল কী করে? এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
একই ব্যক্তি একাধিক শ্রেণীর সংবাদপত্রের মালিক হতে পারবে না- সাংবাদিকদের এমন মন্তব্যের জবাবে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘এটা কিন্তু অনেক দেশেই নেই। এমনকি আমেরিকাতেও একটা টেলিভিশন কোম্পানির মালিক একটা পত্রিকার মালিক হতে পারেন না। আমাদের এখানে একই হাউজে একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আবার একই হাউজে টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন এবং বাংলা-ইংরেজি সংবাদপত্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। একই হাউজ থেকে একাধিক বাংলা পত্রিকা বের হচ্ছে। তাইলে পাঠক কী পাচ্ছে? এখানে কোনো বৈচিত্র্য থাকছে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement