স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও পোশাক খাত নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে
- শাহ আলম
- ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
নানা অপকর্মের অপরাধে স্বৈরাচার ও তার দোসররা পালিয়ে গেলে দেশের পোশাক খাত নিয়ে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। কারণে বছরজুড়ে দেশের গার্মেন্ট খাতে অস্থিরতা অব্যাহত ছিল। এর প্রভাব পড়েছে রফতানি আয়েও। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও দেশের রফতানির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার জন্য তার দলীয় লোকদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
তারা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের কারণে জুলাই বিপ্লবের পর থেকে দেশের পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে অস্থিরতা অব্যাহত ছিল। এর প্রভাবে ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে বড় ধরনের অর্ডার স্থানান্তরিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে হতাশা নেমে আসে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার অনুসারী এবং ভারতীয় এজেন্সিরা অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য শ্রমিকদের বিক্ষোভে উসকানি দিয়েছে। দেশের তৈরী পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে ‘বিদেশি শক্তির’ ইন্ধনও দেখছেন তারা।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিদেশী ক্রেতারা প্রায় ২০ শতাংশ অর্ডার বাংলাদেশের প্রতিযোগী বিভিন্ন দেশ যেমন- ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় স্থানান্তরিত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে এসব ক্রেতা নতুন অর্ডার দেয়ার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে এখনো স্বস্তি না ফেরায় পোশাক শিল্পের ক্রয়াদেশ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমতে পারে।
বিশ্ববাজারে পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থান আছে বাংলাদেশ। দেশের রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রফতানিমুখী তৈরী পোশাক কারখানাগুলো পুরোদমে উৎপাদনে ফিরে আসে। তবে শ্রমিক অস্থিরতায় বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। বছরজুড়ে শ্রম অস্থিরতায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সাথে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা মূল্যের কাজের অর্ডার প্রতিযোগী দেশগুলোতে স্থানান্তরিত হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তপন চৌধুরী বলেন পোশাক খাত অস্থিতিশীল করার পেছনে অনেক ক্ষেত্রে বাইরের ইন্ধন থাকে। বিভিন্ন সময় আমরা দেখছি দেশে কিছু হলেই রাজনৈতিকভাবে পোশাক খাতকে ব্যবহার করা হয়। পুরো পোশাক খাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা হয়।
তিনি বলেন, দেশের রফতানি বাণিজ্যে পোশাক শিল্পের অবদান ৮৫ শতাংশ। এখাতে প্রায় ৪৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের অধিকাংশ নারী। এতে দেশের অর্থনীতিতে নারীদের অবদান বাড়ছে। দেশের তৈরী পোশাক খাতে অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে এখন বেশ কিছু ক্রেতা শ্রীলঙ্কায় চলে যাচ্ছেন। তারা আগে শ্রীলঙ্কারই ক্রেতা ছিলেন, কিন্তু তাদের (শ্রীলঙ্কা) অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে আমাদের দেশে এসেছিলেন। এখন আমাদের এখানে অস্থিতিশীল হওয়ায় আবার ওখানে চলে যাচ্ছেন।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পোশাক খাতে বেশ বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশী ক্রেতারা পূর্ণমাত্রায় অর্ডারের তুলনায় কম অর্ডার দেবেন এটিই স্বাভাবিক।
বিজিএমইএর তথ্যানুসারে গার্মেন্ট খাতে শ্রমিক বিক্ষোভ ১৯ আগস্ট ঢাকা ইপিজেড গেটে শুরু হয়। যেখানে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে কাছাকাছি কারখানায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে বিক্ষোভের প্রভাব কম থাকলেও পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে শ্রমিক নামধারী কিছু দুর্বৃত্তরা কাজ করেছে। এ ছাড়া সাবেক এক এমপি ও মুরাদ জংয়ের অনুসারীদেরও হাত ছিল।
এ দিকে দেশে পোশাক খাত পর্যালোচনায় দেখা গেছে দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। তবে পোশাকের দাম বাড়ছে না। পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরি করতে উদ্যোক্তারা শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও। আন্তর্জাতিক বায়ার বা ক্রেতারা উচ্চমূল্য দিচ্ছে না। এতে বিনিয়োগকারীরা বিপুল বিনিয়োগ করেও সুফল তুলতে পারছে না। আন্তর্জাতিক পোশাক খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডের কাছ থেকে প্রিমিয়াম বা উচ্চমূল্যে পোশাক রফতানিকারকদের জন্য অধরা থেকে যাচ্ছে। যদিও বেশি দামে পোশাক রফতানির জন্য সবুজ কারখানা স্থাপন এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করার জন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, সবুজ কারখানাগুলো বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারে অপচয় রোধ করে থাকে। একই সাথে অভ্যন্তরীণ পরিবেশের গুণমান, কাচা মাল নির্বাচন এবং পরিবেশগত বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বর্তমানে দেশে পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাক ও বস্ত্র কারখানার সংখ্যা ২২৯টিতে দাঁড়িয়েছে।
এ দিকে দেশের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই সাথে বাস্তবায়ন হবে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি। শ্রমিকদের এসব দাবি মেনে নেয়ার মাধ্যমে অবসান হয়েছে গার্মেন্ট খাতের অচলাবস্থা। দেশে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের ১৮ দাবি মেনে নিয়েছে মালিকপক্ষ।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের তৈরী পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে সরকার। একসাথে সংগঠনটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রশাসক হিসেবে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো: আনোয়ার হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বাণিজ্য সংগঠন আইন-২০২২ এর ১৭ ধারায় এ নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
পতিত আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্রের মধ্যেও দেশের পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন তৈরী পোশাকের বৈশ্বিক ক্রেতারা ইতোমধ্যে আগামী বছরের কার্যাদেশ নিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছন। সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও প্রধান শিল্প অঞ্চলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে নতুন কাজের অর্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে যে মন্দা অবস্থা বিরাজ করছিল তা অনেকটাই কেটে গেছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও তাদের দোসররা এখনো দেশের পোশাক শিল্প নিয়ে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথম দিন থেকে সরকারের উচিত তাদের সব ধরনের ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার পরিকল্পনা তৈরি করা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা