২৪ গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নারী ও গণক্ষমতায়ন সম্ভাবনা ও করণীয় শীর্ষক সেমিনার
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সেন্টার অব ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ (সিআইবি) ও নারী সংগঠন উইনের যৌথ আয়োজনে গত শুক্রবার বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত ‘২৪ গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী নারী ও গণক্ষমতায়ন সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। প্রোগ্রামে স্বাগত বক্তব্য দেন রাজনৈতিক গবেষক প্রকৌশলী লোকমান লিমন। সোনিয়া হালিম জুঁইয়ের পরিচালনায় প্রোগ্রামে সভাপতিত্ব করেন প্রকৌশলী মেজবাহুল ইসলাম। প্রোগ্রামে ৩০ জনকে উদ্যোক্তা ও সমাজকর্মী হিসেবে সম্মাননা স্মারক দেয়া হয়।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশকে একটি নান্দনিক ব্যবস্থায় সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।’
সেমিনারে ছেলেদের পিতৃত্বকালীন ছুটির দাবি তোলা হলে তিনি সেই দাবিকে শতভাগ সমর্থন করে বলেন, ‘অবশ্যই পিতৃত্বকালীন ছুটি দরকার; তা না হলে ছেলেরা বউদেরকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, তার পর অফিস থেকে ফোন দিয়ে বাচ্চা হওয়ার খবর জানে।’
তবে নারীদের ১ ঘণ্টা কর্মদিবস কমানোর দাবি উঠলে তিনি তার বিরোধিতা করে বলেন, নারীদেরকে যদি ১ ঘণ্টা আগে ছুটি দেয়ার বিধান হয়, তা হলে অফিসে নারীদেরকে অবমূল্যায়ন করা হবে, পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় তাকে ছোট করে দেখা হবে। নারীর জন্য যদি এক ঘণ্টা কম কর্মদিবস হয়, তবে নারীরা সেই ১ ঘণ্টা কী করবে, বাসায় গিয়ে সংসারের কাজ করবে, সন্তান দেখবে এই তো। তিনি মজা করে বলেন, নারীর জায়গায় পুরুষের এক ঘণ্টা কর্মদিবস কমানো হোক; পুরুষরা এক ঘণ্টা আগে বাসায় গিয়ে সংসারে কাজ সামলাক। আর নারীরা যথাসময়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরে একটু আরাম করুক।
অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ সমাজকল্যাণ সমিতির প্রেসিডেন্ট তাহমিনা আখতার বলেন, ‘নারী ও গণক্ষমতায়ন যথাযথভাবে করতে হলে শিক্ষাকে এক নম্বর গুরুত্বের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।’ সংগঠক, লেখক, গবেষক, সাবেক নাট্যাভিনেত্রী প্রফেসর ফ্লোরা সরকার বলেন, নারীকে পণ্য না করে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার বিকাশ করতে হবে। আর ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের সাংসারিক কাজে পুরুষদের সহায়তা খুব বেশি জরুরি।
এশিয়ান সাইন্টিস্ট, উদ্যোক্তা, উন্নয়ন কর্মী, লেখক ও মডেল লাইভ স্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা: সালমা সুলতানা বলেন, ‘দেশকে এগিয়ে নিতে হলে লাইভস্টকের দিকে নজর দিতে হবে। এতে আমিষের অভাব থাকবে না। খাদ্য নিরাপদ হলে অনেক রোগব্যাধিও থাকবে না।’
নারী অধিকার আন্দোলনের সংগঠক কবি ও লেখক নূরুন্নাহার নীরু বলেন, এ সমাজে শুধু নারীরাই নির্যাতিত, বঞ্চিত তা নয়! পুরুষরাও বৈষম্যের শিকার। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সে অবস্থা নিরসনের পথ খুলে দিয়েছে, এখন পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, আস্থা রেখে গঠনমুখী কাজে এগিয়ে যাওয়ার পালা। এ জন্যই নারীর ক্ষমতায়ন অর্জন করতে নারীর আত্মিক উন্নতি প্রথম প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
মহীয়সী ডটকমের (িি.িসড়যরড়ংযর.পড়স) সম্পাদক শারমিন আকতার বলেন, ‘সমাজের অর্ধেক নারী, আর বাকি অর্ধেককে গড়ে তোলে নারী; তার মানে পুরো সমাজটাই যেন নারী। সেই নারীরা পিছনে থাকলে সমাজ কখনো সামনে এগিয়ে যাবে না। যে জাতির নারীরা জ্ঞান ও শিক্ষায় যত এগিয় গেছে সে জাতি তত বেশি সমৃদ্ধ। তিনি বেগম রোকেয়ার উক্তি দিয়ে বলেন, পরিবার বা সমাজ নারী ও পুরুষ মিলে একটা দ্বিচক্রযানের মতো; যেখানে এক চাকা নারী আর এক চাকা পুরুষ। এখন জ্ঞান ও বিদ্যাবুদ্ধিতে একটি চাকা (নারী) যদি ছোট হয় তাহলে সে শকট (যান) সামনে যেতে পারবে না; এক জায়গাতেই ঘুরতে থাকবে।’
নারী অধিকার আন্দোলনের সংগঠক মানার এডুকেশন ইনস্টিটিউশনসের অ্যাকাডেমিক সেক্রেটারি এবং বর্ণালি বুক সেন্টারের সিইও ড. সাজেদা হোমায়রা বলেন, ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের সাহসী ও নির্ভীক ভূমিকা ছাড়া ১৬ বছরের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না। গণ-অভ্যুত্থানের নারীরা যেভাবে অসীম সাহসিকতায় অভ্যুত্থানকে সফল করেছিলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও তারা যেন আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন, সে সুযোগ যেন নিশ্চিত করা হয়।’
আইনজীবী, সংগঠক, সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের নারী ইউপি সদস্য বৃদ্ধি করে ৯ জন করা দরকার। একজন নারী ইউপি সদস্যর জন্য কাজকর্মে ৩টা ওয়ার্ড কাভার করা কঠিন। ইউনিয়নের প্রতি ওয়ার্ডে নারী স্বাস্থ্য কেন্দ্র করা দরকার। ইউনিয়ন পর্যায়ে নারী দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকারি দক্ষতা সেন্টার করতে হবে এতে নারীরা এগিয়ে যাবে।
নারী অধিকার আন্দোলনের আরেক নেত্রী ও সুবিধাবঞ্চিত নারী, কিশোরী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা ডা: হাবিবা হাসনাত বলেন, সম্ভাবনাময়ী নারীরা অনুৎপাদনশীল কাজে সময় নষ্ট না করে সামাজিক উন্নয়নের কাজে যাতে মনোযোগী হতে পারে তার সুব্যবস্থা প্রয়োজন।
সাবেক সচিব ম. আ কাশেম মাসুদ বলেন, ‘হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল, মাছ চাষে বাচ্চার জন্য ও ফিডের জন্য বড় করপোরেট কোম্পানিগুলোর সর্বনাশা সিন্ডিকেট রয়েছে। এখানে বাচ্চার দাম, খাদ্যের দাম, পাইকারি দাম ও খুচরা দাম ফিক্সড করে না দিলে খামারিদের বাঁচানো যাচ্ছে না। গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তিতে এটি বিপ্লব সৃষ্টি করবে।’
৯০-এর ছাত্রঐক্যের কেন্দ্রীয় সদস্য, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের নেতা কামাল হোসেন বাদল বলেন, ‘সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যে সহনীয় রাখতে হলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গাড়ি করে শহরে সবজি নিয়ে আসতে হবে। সরকারিভাবে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের আলাদা চেইন তৈরি করে ডিস্ট্রিবিউট করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।’
অ্যাডভোকেট জান্নাতুল ফেরদৌস সারা বলেন, ‘সাংসারিক ব্যস্ততা সামলানোর জন্য কর্মজীবী নারীদের অফিস টাইম এক ঘণ্টা কমানোর দাবি করছি। নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নারী কর্মসংস্থান জরুরি। তাই কর্ম স্থানে নিরাপত্তাও জরুরি। আদালত ও পুলিশ প্রশাসনে সাইবার ও পারিবারিক বিষয়ে ডিল কনরা জন্য ব্যবস্থা থাকলেও নারীদের কর্ম স্থানে পেইন নিরসনে থানা ও আদালতে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার।’
কবিতা ক্যাফের পরিচালক, লেখক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাহিদা আশরাফি বলেন, ‘বিধবা ও ডিভোর্স ভাতা, বেকার ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা ফান্ড সরকারিভাবে করার পাশাপাশি বেসরকারিভাবে ফান্ডরেইজ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন জরুরি। স্কুল-কলেজে ও শহর এলাকাগুলোতেও নারীদের ব্যায়াম ও খেলাধুলার পর্যাপ্ত ইনডোর ব্যবস্থা এখনো নেই। এ বিষয়ে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে।’
চাকরিতে প্রবেশের সীমা ৩৫ আন্দোলনের নেতা ইফতেখার চৌধুরী বলেন, ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ ক্ষেত্রবিশেষে উন্মুক্ত করলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে নারীরা। নারীদের বেশির ভাগের ৩০-৩২ বছর বয়স চলে যায় গ্র্যাজুয়েশন কোনোভাবে সম্পন্ন করা, বাচ্চা বড় করা ও শ্বশুরবাড়ির সাথে অ্যাডজাস্টমেন্টে। সমাজ ও দেশ পরিচালনায় নারীদের আরো ব্যপক উপস্থিতির জন্য চাকরিতে বয়সের প্রবেশ সীমা কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ৩৭ করার উচিত।’
বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সদস্য ফারজানা আহমেদ বলেন, ‘জনসমস্যা লাঘবে ব্যাপকভাবে সমবায় করতে হবে এবং সমবায় আইন সহজ করতে হবে। ঢাকা শহরে নারীদের জন্য যানবাহন এখনো অপ্রতুল। এ বিষয়টি সরকার নজরে নিলে ভালো হয়।’
মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন কুরআন মজলিস সংগঠনের চেয়ারম্যান মিয়া সিরাজ, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন সার্বভৌমত্ব আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সংগঠক ফুয়াদ স্বনম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর কামরুল ইসলাম জুয়েল,স্বদেশী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী আল আমিন রাজু, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ হোসেন আলী সরকার, এশিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. মো: আবু জাফর সিদ্দিকী, দেশপ্রেমিক প্রজন্মের আহ্বায়ক আল কাওসার মিয়াজি, ২৪ আন্দোলনে আহত আন্দোলনকারী চম্পা আক্তার, নারী উচ্চারণ ও খেদমত ইকমার্স প্রেসিডেন্ট সামিয়া রহমান, সাংবাদিক কানিজ ফাতেমা সূচী, যুব সংগঠক পিংকি কনিকা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা