পুলিশের গুলিতে পা হারিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন কামাল উদ্দিন বিকম
মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে আটক- আরফাত বিপ্লব চট্টগ্রাম ব্যুরো
- ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন পড়েছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সরকারি কলেজের কমার্স বিভাগে। ছাত্রজীবনে ছাত্রশিবির ও কর্মজীবনে জামায়াতের সমর্থক ছিলেন। গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের ছেইল্লার বাড়ি এলাকায়। জীবনের একটা সময় কাটিয়েছেন প্রবাসে। প্রবাস থেকে দেশে ফিরে ২০১৪ সালে শিকার হন পুলিশের নির্যাতনের। তার ভাষায় ক্রসফায়ারের উদ্দেশ্যে পুলিশ নিয়ে গেলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তবে হারিয়েছেন একটি পা। এখন এক পা ও ক্র্যাচের ওপর ভর করে জীবন কাটে কামাল উদ্দিনের।
বয়স ৪৫ বছর, জীবনের এই বাঁকে এসে নানা দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে নিঃসন্তান কামাল উদ্দিনের। গতকাল নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় তার।
তিনি জানান, ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সদ্য প্রবাস ফেরত ছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন কর্মী বাড়িতে এসে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে, দিতে অস্বীকার করলে তারা খুন করে লাশ গুমের হুমকি দেয়। এ ঘটনার পর আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে গ্রাম ছেড়ে শহরে বাসা ভাড়া করে থাকা শুরু করেন। গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দেন। একরকম আত্মগোপনে চলে যান। এদিকে তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে হুমকিদাতা ক্যাডাররা। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা হাজেরা খাতুন। তখন তার বয়স ছিল ৬৫ বছর।
২০১৪ সালের ৫ জুলাই বিকেল ৪টা। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে চট্টগ্রাম মহানগরীর দেওয়ানহাট এলাকায় যান। এসময় হঠাৎ একদল লোক সাদা পোশাকে এসে কামালকে ঘিরে ধরে। ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। কামাল উদ্দিন বলেন, যখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি এলাকার হুমকিদাতা সন্ত্রাসীদের কয়েকজনকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সম্ভবত তারাই দেখিয়ে দিয়েছে।
এরপর আমাকে অন্ধকার একটা আবদ্ধ রুমে বেঁধে বেধড়ক পেটানো হয়। একপর্যায়ে নির্যাতনকারী অফিসার কার সাথে ফোনে কথা বলেন। মনে হলো তৎকালীন চট্টগ্রাম-১৫ আসনের এমপি আবু রেজা নদভীর সাথে কথা বলেছেন। রাত তখন সম্ভবত ১১-১২টা। হঠাৎ আমাকে একটা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে ৫০-৫৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছিল বলে মনে হয়। গাড়িতে ওদের পারস্পরিক কথাবার্তা চলছিল। একপর্যায়ে বলল, তখন যদি এমপি সাহেবের নির্দেশমতো টাকা-পয়সা দিয়ে ফেলত তাহলে এই অবস্থা হতো না।
যখন আমাকে গাড়ি থেকে নামানো হলো তখন সম্ভবত রাত ২টা। নেমে ভালো করে এলাকাটা চেনার চেষ্টা করলাম। মনে হলো, সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা কাজীর মসজিদের পশ্চিম পাশের পাহাড়ি এলাকায় স্লুইস গেটে যাওয়ার রাস্তা। এই এলাকাটা নির্জন। এর একটু পরেই বাঁশখালী উপজেলার সীমানা। গাড়ি থেকে নামিয়ে আমাকে আবারো নির্যাতন শুরু করল ওরা, বলল টাকার চেয়ে কি জীবনের মূল্য বেশি? টাকা দিসনি কেন?
এখানে একসাথে ৪-৫ জন আমাকে নির্যাতন করে। এলাপাতাড়ি কিলঘুষি মেরে আমাকে দুর্বল করে ফেলে। একপর্যায়ে সবাই মিলে আমাকে চিত করে ফেলে দেয়। কেউ মাথা চেপে ধরে, কেউ হাত চেপে ধরে। একজন আমার বুকের ওপর পা দিয়ে চেপে ধরে। তখন মনে করেছিলাম, হয়তো এটাই আমার জীবনের শেষ দিন। আমাকে ক্রসফায়ার দেয়া হচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন আমার পায়ে গুলি করে। বিকট শব্দ। রক্তে ভেসে যায় চারপাশ। আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ি। তখন আমার বয়স ছিল ৩৫ বছর। এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় চমেক হাসপাতালে। সেখানে আমাকে বিনা চিকিৎসায় ১০-১২ দিন ফেলে রাখা হয়। পুলিশ পাহারায় থাকত, কিন্তু আদালতে সোপর্দ করত না। পরে আমার ডান পা কেটে ফেলা হয়।
এ ঘটনার এক মাস একদিন পর একটি অস্ত্র মামলা দিয়ে আমাকে আদালতে সোপর্দ করে। সেই মামলার বাদি ছিল এসআই নাজমুল হক। আদালত আমাকে জেলে পাঠান। এভাবে একটানা প্রায় দুই বছর কারাগারে থাকি। কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে এক পা নিয়ে চলছে জীবন। আমার অবস্থা দেখে দুশ্চিন্তায় বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তিনিও আমাকে ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে।
সম্প্রতি ১০ বছর আগের এ ঘটনা নিয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন। গত সপ্তাহে তিনি একটা মামলা করেছেন। সেখানে আসামি করেছেন সাবেক এমপি আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী, পুলিশের এসআই নাজমুল হক, এসআই কাজী শফিকুল ইসলাম, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ক্যাডার নজরুল ইসলাম মানিক, আব্দুল করিম প্রকাশ ডু করিম, নুরুল আলম, আব্দুস ছালাম প্রকাশ মাছ ছালাম, মোহাম্মদ শফিসহ ৩১ জনকে। বর্তমানে তিনি বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছেন।
চট্টগ্রামের সিনিয়র আইনজীবী মঞ্জুর আহমদ আনসারী নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্যাতনের জীবন্ত সাক্ষী কামাল উদ্দিন। তিনি বর্তমানে একটা পা নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমরা মামলা করেছি। আদালত মামলা গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা আশা করছি কামালুদ্দিন ন্যায়বিচার পাবেন। তার ন্যায়বিচারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, শুধু কামাল নয়, এরকম নিরীহ অনেক মানুষকে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করেছে জালিমবাহিনী। সব অন্যায়-অবিচারের বিচার হবে ইনশাআল্লাহ।
একই আসনের আরেক সাবেক এমপি মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম বলেন, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ। এমন কোনো গ্রাম-পাড়া-মহল্লা নেই যেখানে সাধারণ মানুষ আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়নি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা