১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পুরান ঢাকায় ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো দালালনির্ভর

আয়ের উৎস মিটফোর্ড হাসপাতাল
-


রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড রোডের আশপাশসহ নয়াবাজার, তাঁতীবাজার ও রায়েশাবাজারে শতাধিক প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এখন দালালনির্ভর। ওই সব প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের রোগীরা। এমনকি বেশির ভাগ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে কোনো অনুমোদনও নেই।
জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালের পঞ্চাশ গজের মধ্যে কোনো প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকতে পারবে না। এমন আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতাল ঘেঁষেই ২০ থেকে ২৫টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে খোদ মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তাররাই রোগী দেখেন। এমনকি তারা রোগী শিফট করতেও দ্বিধা করেন না এসব ক্লিনিকে। তা ছাড়া প্রতিটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিজস্ব দালাল রয়েছে। ওই দালালরাই মিটফোর্ড হাসপাতালের আউটডোর এবং ইনডোরের রোগী ও তার স্বজনদের ফুসলিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যায়। এরপর শুরু করে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে বাণিজ্য। তবে ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার করতে যেসব নিয়ম থাকা দরকার তা কিছুই নেই ওইসব প্রতিষ্ঠানের। বিশেষ করে অভ্যর্থনা ও তথ্য সংগ্রহ কক্ষ, রোগীর জন্য অপেক্ষমাণ স্পেস, নমুনা সংগ্রহ কক্ষ, নিজস্ব স্থাপনা ও মূল ল্যাব বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে এসবের কিছুই নেই। পরীক্ষা নিরীক্ষার মেশিন অকেজো। তার পরও ওই ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে থাকে।

এদিকে, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রথম গেইটের দেয়াল ঘেঁষেই রয়েছে কয়টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। তার মধ্যে মুনলাইট, বাঁধন ক্লিনিক, ইস্টার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মুনলাইট ক্লিনিক অ্যান্ড হাসপাতাল, মেডি লাইফ স্পেশালাইড হাসপাতাল ও ম্যাক্স লাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টার অন্যতম। দ্বিতীয় গেইটে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে আল আরাফাত হাসপাতাল, বাঁধন হাসপাতাল, ম্যাক্স এইড হাসপাতাল, নিউ ঢাকা মডার্ন ক্লিনিক, ফিজিওথেরাপি বিভাগ ঢাকা হাসপাতাল, আলফা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড হাসপাতাল, ঢাকা হাসপাতাল।
তৃতীয় গেইট দিয়ে বের হলেই চোখে পড়বে ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল, মেডিসিন হেলথ্ কেয়ার, ডক্টরস ক্লিনিক অ্যান্ড হাসপাতাল।

সূত্র জানায়, মিটফোর্ড হাসপাতালের কিছু ডাক্তার নিয়মিত ওই সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী দেখেন। আবার কেউ কেউ নিজেই মালিক। এসব ক্লিনিক ও প্রাইভেট হাসপাতাল নামে মূলত সেবার নামে প্রতারণা করাই ওদের কাজ। তা ছাড়া ওদের রয়েছে নিয়োগ দেয়া নিজস্ব দালাল। আউটডোরে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন মিটফোর্ড হাসপাতালে। টিকিট কাটতে পারলেও তিন দিনেও মিলে না ডাক্তার। এমন সুযোগ নিয়েই দালালরা নানান কথা বলে ওই সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী নিয়ে যায়। এরপর ডাক্তার না থাকলেও স্টাফরা ডাক্তার সেজে রোগীদের চিকিৎসার নামে ২০ থেকে ২২টা পরীক্ষা দিয়ে থাকে। কেরানীগঞ্জ মডেল টাউনের বাসিন্দা বাড়িওয়ালা খালেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকা হাসপাতালে বসেন মিটফোর্ড হাসপাতালের একজন অর্থপেডিকস ডাক্তার। পায়ের গোড়ালি সমস্যা মিয়ে গেলে পরীক্ষা ও চিকিৎসার নামে এক বছরে ৯ লাখ টাকা খরচ করিয়েও ভালো করতে পারেনি। গত সোমবার শরীয়তপুর থেকে চিকিৎসা নিতে আসেন রাবেয়া আক্তার। সকাল ৮টায় মিটফোর্ড হাসপাতালের টিকিট কাটার জন্য লাইনে দাঁড়ান। ঠিক এ মুহূর্তে বোরখা পরিহিত এক পাশে এসে বলতে থাকেন টিকিট কাটতে পারলেও তিন দিনেও ডাক্তার দেখাতে পারবেন না। এত ভিড়ের চেয়ে পাশেই আল আরাফাত হাসপাতাল রয়েছে। ওখানে মিটফোর্ডের আরপি স্যার বসেন। তাছাড়া তিনি বড় মাপের ডাক্তার। তাই ওখানে তিন শ’ টাকায় ডাক্তার দেখাতে পারবেন। ওইখানে ডাক্তার দেখালে ২৫টি পরীক্ষা দেন ডাক্তার। ৪২ হাজার টাকা বিল করে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। সামান্য পেটব্যথা নিয়ে হাসপাতালে এসে পরীক্ষা করাতেই যদি এত টাকা লাগে, তাহলে ওষুধ কী দিয়ে কিনব। তাছাড়া আমি গরিব মানুষ। এসব বলার পর দুই হাজার টাকা কমান তারা।
কেরানীগঞ্জ কালিন্দীর বাসিন্দা নিজামুল এ প্রতিবেদককে বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গেলে দালালের খপ্পরে পড়ে হাসপাতালের পাশেই ম্যাক্সলাইফ হসপিটালে যান তিনি। ওখানে মাথা ব্যথা নিয়ে গেলে সিটিস্ক্যানের কী মেশিন দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করালো বুঝেই উঠতে পারছি না। পরে জানতে চাইলে স্টাফরা বকাবকি করে আর বলে যে এই হাসপাতালের মালিক কে তা তো জানেন না। তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার বেলাল স্যার।

অন্য দিকে, ভিক্টোরিয়া ডায়াগনস্টিক নামে প্রতারণা করছে প্রতিষ্ঠানটি। মিটফোর্ড রোডে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া কনসালটেশন ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড হাসপাতাল কর্তৃক সরকারি হাসপাতালের রোগী বাগিয়ে নেয়া ও সেবার মানে চরম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। গত বুধবার সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, একটি চক্র মিটফোর্ড হাসপাতালের দূর-দূরান্তের রোগীদের সেবা থেকে সরিয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে পাঠাচ্ছে। বাস্তবে ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল পরিদর্শন করলে দেখা যায় সেটি একটি আবাসিক হোটেলের অবয়ব। নিচের দোতলায় দৈনন্দিন তৈজসপত্রের মার্কেট, ওপরে হাসপাতাল। ২০ শয্যার ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা ১৫ শয্যায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে জরুরি সেবা প্রদান ও পরিষেবার মূল্য তালিকা প্রদর্শনে রয়েছে চরম অব্যবস্থা। মূল প্রবেশপথে বড় রিসেপশন থাকলেও সেখানে সেবার মূল্যতালিকা প্রদর্শিত হয়নি। জরুরি সেবারও কোনো ব্যবস্থা না থাকায় রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ছে। কোনো রোগীও তার কোনো প্রতিবাদ করলেই মারধর করে টাকা পয়সা রেখে দেয়।

এদিকে, মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে বেশির ভাগ রোগী ডাক্তারের মাধ্যমে পপুলার ও মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বেশি যায়। তা ছাড়া ওই দুই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব দালাল রয়েছে প্রায় ৪০ জন। তারা মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রতিটা ওয়ার্ডে একজন করে রয়েছে। মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করে থাকে। তা ছাড়া প্রতি ওয়ার্ডের ডাক্তারের টেবিলে রয়েছে পপুলার ও মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ঠিকানাপত্র। ওখান থেকেই ডাক্তার রোগী পাঠান ওইসব ক্লিনিকে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর মহাপরিচালক আবু জাফর নয়া দিগন্তকে বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালের রোগী বাগিয়ে নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে সেবার নামে প্রতারণা করছে এমন অভিযোগ যেসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা কোনো প্রাইভেট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিললেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement