১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কেরানীগঞ্জে গ্যাসের জন্য হাহাকার

আ’লীগ নেতার নেতৃত্বে ৬৫ হাজার অবৈধ সংযোগ
-

রাজধানীর উপকণ্ঠ ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবৈধ সংযোগের কারণে গ্যাসের জন্য হাহাকার পড়েছে। দিনে পাওয়া যাচ্ছে না গ্যাস, জ্বলছে না চুলা। কেউ কেউ মধ্যরাতে উঠে রান্না করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ কোনো কোনো বাসায় গ্যাস আসে রাত ১টার পরে। বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুষ সিলিন্ডার গ্যাস ও ইলেকট্রনিক চুলার দিকে ঝুঁকছেন। এতে কেরানীগঞ্জবাসীকে মাসিক গ্যাসের বিলের পাশাপাশি বাড়তি গুনতে হচ্ছে সিলিন্ডারের দেড় হাজার টাকা। যারা ইলেকট্রনিক চুলা ব্যবহার করছেন তাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি বিদ্যুৎ বিল।
এ চিত্র কেরানীগঞ্জ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে। এ জন্য এলাকাবাসী তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির অবৈধ কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন।
এলাকাবাসী জানান, আওয়ামী লীগ নেতা, বঙ্গমাতা সংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শেখ শাহ আলমের নেতৃত্বে ৪৭ জন ঠিকাদার ও তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে গত ১৫ বছরে কেরানীগঞ্জে প্রায় ৬৫ হাজার অবৈধ গ্যাস লাইনের সংযোগ দেয়া হয়েছে। যেখান থেকে বাসা বাড়ির চুলা প্রতি ১ হাজার টাকা করে ৬৫ হাজার অবৈধ চুলা থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৭ কোটি টাকা আদায় হয়। এই অবৈধ টাকার অংশ রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এমডি পর্যন্ত মাসোয়ারা চলে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কেরানীগঞ্জ উপজেলার দু’টি থানা এলাকায় বারোটি ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ইউনিয়ন গ্যাস সুবিধার বাইরে। বাকি ৯টি ইউনিয়নে প্রায় ১৫ লাখ লোক বসবাস করেন। যার মধ্যে কেরানীগঞ্জ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ৩০ হাজার বৈধ গ্যাস লাইনের গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে বিল পরিশোধ না করায় ৫ হাজার লাইন বিচ্ছিন্ন করেছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি।
গতকাল উপজেলার হাসনাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তিন সন্তানের জননী আকলিমা বেগম লাকড়ি দিয়ে মাটির তৈরি চুলায় রান্না করছেন। তিনি জানান, গ্যাসের চুলা জ্বলে রাত দেড়টার পরে। সকালে ছেলেমেয়েরা কাজে যাবে তাই গ্যাস না পেয়ে মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে হচ্ছে। একই এলাকার অনেককে বিভিন্ন ঘরে ইলেকট্রনিক চুলায় রান্না করতে দেখা যায়। এ ছাড়া প্রায় সব ফ্ল্যাট বাড়িতেই তিতাস গ্যাসের চুলার পাশাপাশি রয়েছে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার।
জানা যায়, হাসনাবাদ এলাকায় পাঁচ শতাধিক আবাসিক ভবন থাকলেও বৈধ চুলার সংখ্যা মাত্র দুইশত। ওই এলাকার রয়েছে, একাধিক মিল ফ্যাক্টরি ও ওষুধ কোম্পানি এবং বসুন্ধরা গ্রুপের অর্ধশত স্থাপনা। হাসনাবাদ এলাকার মতো একই চিত্র এলাকার অন্যসব ইউনিয়নে। কেরানীগঞ্জের জিনজিরায় অবস্থিত তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন অফিস থেকে জানা যায়, হাসনাবাদ, ইকুরিয়া, মীরেরবাগ, খেজুরবাগ, কালিগঞ্জ, সুভাঢ্যা, চুনকুটিয়া, আগানগর, জিঞ্জিরা, কালিন্দী, শাক্তা, তারানগর, কলাতিয়া ও হজরতপুর এলাকায় বৈধ গ্যাস লাইনের সংখ্যা ৩০ হাজার। এর মধ্যে ৫ হাজার লাইন তারা বিভিন্ন সময় বিল পরিশোধ না করার কারণে বিছিন্ন করেছেন।
আগানগর এলাকায় অবৈধ সংযোগ নিয়ন্ত্রণ করছেন, আওয়ামী লীগ নেতা রাসেল মেম্বার। কদমতলী সারা কমিউনিটি সেন্টারের গলিতে ২০ থেকে ২৫টি বাড়িতে ৩ শতাধিক অবৈধ গ্যাসের চুলা রয়েছে। এখান থেকে প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা অবৈধ আদায় করেন আওয়ামী লীগ নেতা ইউসুফ ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নের একজন ঠিকাদার।
জিনজিরা মডেল টাউন এলাকায় রয়েছে প্রায় ১৫০টি বহুতল ভবন। ২০১৬ সালের পর এসব ভবন নির্মাণ হওয়ায় মডেল টাউনের বেশির ভাগ ভবনে বৈধ কোনো গ্যাসসংযোগ নেই। কয়েকজন দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার বিভিন্ন বৈধ গ্যাস গ্রাহকের দলিল ও পর্চা নকল তৈরি করে মডেল টাউনসহ কেরানীগঞ্জের ৯টি ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজার স্থানে অবৈধ গ্যাসের সংযোগ দিয়েছেন। এসব সংযোগ দিতে সহায়তা করেন কেরানীগঞ্জ তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের ম্যানেজার ও উপব্যবস্থাপক। মডেল টাউনে অবৈধ গ্যাসের চুলা নিয়ন্ত্রণ ও সংযোগ কাজে জড়িত রয়েছে ঠিকাদার এনায়েত, ইউসুফ, শাহ আলম। জিনজিরা ইউনিয়নে অবৈধ সংযোগ রয়েছে প্রায় ২৫০টি। অবৈধ সংযোগের সাথে রয়েছে ঠিকাদার শামীম। বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছে যুবদলের আবু জায়ীদ মামুনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ। জিনজিরা ইউনিয়ন থেকে অবৈধ গ্যাসের চুলা ও ফ্যাক্টরি থেকে মাসে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করা হয়।
জিনজিরা নামা বাড়ি এলাকায় রয়েছে দু’টি পাকঘর। নিম্ন আয়ের ২০ থেকে ২৫ জন গৃহিণী এই পাকঘরে পাকের বিনিময়ে প্রতি মাসে পাঁচশত টাকা করে পরিশোধ করেন।
কালিগঞ্জ, পূর্ব আগানগর এলাকায় রয়েছে ঠিকাদার শাহ আলম, ফিরোজ ও বাবুলের নেতৃত্বে শতাধিক ওয়াশিং কারখানা, আয়রন ফ্যাক্টরি, ডাইং ফ্যাক্টরি। কালিগঞ্জ ও পূর্ব আগানগর এলাকা থেকে প্রতি মাসে অবৈধ কালেকশন হয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। কালিন্দী ইউনিয়নের অবৈধ গ্যাসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ঠিকাদার সিরাজ। কালিন্দী ইউনিয়নের তার ২৫টি ডাইং ফ্যাক্টরি রয়েছে। এসব ফ্যাক্টরি থেকে সিরাজ, শাহ আলমের নেতৃত্বে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা আদায় করা হয়। আদায়কৃত টাকার একটি অংশ পেয়ে থাকেন, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কেরানীগঞ্জ অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে তিতাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্যন্ত।
কেরানীগঞ্জ তিতাস গ্যাস ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির একজন সদস্য নাম না বলার শর্তে নয়া দিগন্ত প্রতিনিধিকে বলেন, ভাই লেখালেখি করে কোনো লাভ নাই। তিতাস গ্যাসের পিয়ন থেকে শুরু করে এমডি পর্যন্ত আমাদের টাকায় চলে। টাকার ভাগ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও। এর মধ্যে সাংবাদিকদের তালিকাও আছে।
এসব অনিয়ম ও অবৈধভাবে তিতাস গ্যাসের লাইন সম্পর্কে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন জোন ৫ জিনজিরা অফিসের ম্যানেজার বিধান চন্দ্র মৈত্র বলেন, কেরানীগঞ্জে তিতাস গ্যাসের অসংখ্য অবৈধ লাইন রয়েছে এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে গত এক বছরে অর্ধশত অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্ন করেছেন। কিভাবে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ হাজার অবৈধ লাইন চলছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমাদের অজান্তেই এগুলো হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা বিগত দিনে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ লাইন দিয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement