ঘুষ ছাড়াই হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের বদলি-পদায়ন
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৪
মিজানুর রহমান, একজন তরুণ মেধাবী চিকিৎসক। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন ২০১৪ সালে। এরপর নিউরোলজি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি এফসিপিএস পার্ট-১ পাস করেন ২০১৮ সালে। ২০২০ সালে বিসিএস পাস করে চাকরিতে যোগদান করেন। সে সময় কোভিড হাসপাতালে পোস্টিং হলো তার। দিনরাত কোভিডের সাথে যুদ্ধ করে দিন কাটে তার। দুই বছর পর কোভিড হাসপাতাল বন্ধ হলে তার পোস্টিং দেয়ার কথা ওঠে। কোথায় পোস্টিং হয় তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তার নাই পোস্টিং করিয়ে দেয়ার মতো মামা-চাচা। আবার পোস্টিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিতে হয় ৬-৮ লাখ টাকা। সরকারি চাকরি করে যা বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। সেখানে ৬-৮ লাখ টাকা পাবেন কোথায়। আল্লাহর ওপর ভরসা করে পোস্টিংয়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। একদিন তার মোবাইলে আসে একটি খুদে বার্তা। হাতে নিয়ে দেখেন পোস্টিংসংক্রান্ত। দ্রুত এইচআরএমে ঢুকে দেখেন তার পোস্টিং ভূষণছড়ি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বরকল, রাঙ্গামাটি। টাকা না দেয়ায় তার পোস্টিং হয়েছে এখানে। রাঙ্গামাটি থেকে নৌপথ ছাড়া কোনো উপায় নাই। নৌপথে যেতে সময় লাগে ৩-৪ ঘণ্টা। যেখানে তার পোস্টিং সেখানে নাই মোবাইলের নেটওয়ার্ক, পানি-বিদ্যুতের ব্যবস্থা। চিকিৎসক বলতে সেখানে তিনি ও আর তিনজন। টানা ২৪ ঘণ্টা করে ডিউটি করতে হতো তাকে। পরিবারের সাথে যোগাযোগ হতো না। কেউ অসুস্থ হলে বা মারা গেলেও জানা সম্ভব হতো না।
ছাত্রাবস্থা থেকে স্বাধীন চেতা ডা: মিজানুর। স্বৈরশাসকের অনৈতিক কাজের কিছু সমালোচনা করায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপের রোষানলে পড়েন তিনি। তাই তার আর পোস্টিং পরিবর্তন হয় না। তার সাথে অনেকের পোস্টিং পরিবর্তন হলেও তার হয়নি। এ দিকে নিউরোলজি বিভাগে পোস্টিং না হওয়ায় এফসিপিএস ডিগ্রিও শেষ করতে পারছিলেন না তিনি। ফিঁকে হয়ে আসছিল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। ভেবেছিলেন কোনোদিন আর নিউরোলজিস্ট হতে পারবেন না।
জুলাইয়ের গণবিপ্লবের পর ডা: মিজানুরের মনে আশা জাগে। আশার আলো দেখতে পান। কিন্তু মনে শঙ্কা কাটে না। গেল ১৭ বছরের সিস্টেম কি আসলেই পাল্টে যাবে?
দুরুদুরু বুকে পোস্টিংয়ের জন্য এইচআরএমে আবেদন করেন। এবার কারো কাছে গেলেন না। কাউকে টাকা দেয়ার জন্য সাধলেনও না। আবেদন করে গহিন পাহাড়ি এলাকায় চলে গেলেন ডিউটিতে। মাস খানেক পর চট্টগ্রামে অবস্থানকালে তার মোবাইলে খুদেবার্তা আসে। পোস্টিংসংক্রান্ত। দুরুদুরু বুকে এইচআরএমে ঢুকে দেখেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের নিউরোলজি বিভাগে তার পোস্টিং হয়েছে। খুশিতে কেঁদে ফেলেন তিনি। নতুন করে স্বপ্ন দেখেন নিউরোলজিস্ট হওয়ার।
ডা: মিজানুরের মতো এমন হাজারো চিকিৎসকের পোস্টিং হয়েছে কোনো টাকা ছাড়া, কোনো মামা-চাচা ছাড়া। এমন অনেকেই আছেন যারা কোনো দিন চিন্তাও করেন নাই তারা কাক্সিক্ষত পদে পদায়িত হবেন।
ডা: যাকারিয়া অর্থোপেডিক্স সার্জন। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে তাকে নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। মাত্র তিন মাসের মাথায় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চৌহালীতে পোস্টং করা হয়।
ডা: যাকারিয়া বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চৌহালী সরকার ঘোষিত দুর্গম উপজেলার একটা। এমন একটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, যেখানে ওপরে টিনশেড ঘরে কয়েকটা রুমে কার্যক্রম চলে, ইনডোর নেই, ডাক্তারদের থাকার কোনো ডরমিটরি নেই। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে এমন পোস্টিং আকাক্সিক্ষত নয়। এতে দেশের ক্ষতি হয়। সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর কোনো টাকা ছাড়াই আমি আবার নিটোরে পোস্টিং পাই। রোগীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো: আবু জাফর মিলে বদলি বাণিজ্যের সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, ষষ্ঠ গ্রেড ও তার ওপরের গ্রেডের চিকিৎসকদের পোস্টিং হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। আর নিচের গ্রেডের চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিকিৎসক অনেক বেশি তাই এখানে বদলি বাণিজ্য বেশি হতো। ৩ মাস আগেও স্বৈরাচারের সময় স্বাস্থ্য খাত ছিল চরম দুর্নীতির জায়গা। প্রতিটি পদায়নের জন্য লাখ লাখ টাকা দিতে হতো। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইতিহাসে বদলি বাণিজ্যের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে আছে অধ্যাপক সামিউল ইসলাম সাদীর নাম। তিনি বদলি বাণিজ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। কোটি কোটি টাকার বদলি বাণিজ্য করেছেন তিনি। তাকে সহায়তা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল উইংয়ের মেডিক্যাল অফিসার ডা: সালেহীন তৌহিদ ও ডা: তমাল। স্বাচিপের কেন্দ্রীয় নেতা ডা: মো: জাবেদ ও ডা: শিশির সিক্ত সরকার আলাদাভাবে বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন।
এ ছাড়া সহকারী পরিচালক পার-৩ ডা: সাফিন জব্বার, পার-৪ ডা: মাহমুদুল বাশার, পার-২ রওশন জাহান আলোর ব্যাপারে অভিযোগ আছে। সিডিসির লাইন ডাইরেক্টর ডা: শেখ দাউদ আদনানের নামে অভিযোগ আছে। তার বিরুদ্ধে আরো বড় অভিযোগ হলো তিনি ৫ আগস্টের আগে হাসপাতাল উইংয়ের উপপরিচালক থাকা অবস্থায় গণবিপ্লবে আহত ছাত্র-জনতাকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে নিষেধ করেছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন স্বাচিপের চিকিৎসক জানান, অধ্যাপক সামিউল ইসলাম সাদী বদলি বাণিজ্য শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কেউ পোস্টিংয়ের জন্য আবেদন করলে তিনি প্রথমে খুব খারাপ জায়গায় পোস্টিং দিতেন। যোগদানের পর পোস্টিং পরিবর্তন করতে আসলে টাকার বিনিময়ে পোস্টিং করাতেন। তার একেক জায়গার জন্য একেক রেট ছিল। ঢাকার জন্য ১০-১২ লাখ টাকা, বিভাগীয় শহরে ৬-৮ লাখ টাকা ও জেলা শহরে ৪-৬ লাখ টাকা। তিনি স্বাচিপের লোকদের কাছে থেকেও টাকা নিতেন। এর একটি অংশ পেত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। শুধু অধ্যাপক সাদী না স্বাচিপের কেন্দ্রীয় নেতা ডা: জাবেদও ৫-১০ লাখ টাকার বিনিময়ে বদলি বাণিজ্য করতেন।
এ প্রতিবেদক ৫ আগস্টের পর পদায়ন পাওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ১০০ জন চিকিৎসকের সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু কেউই পদায়নের সাথে বাণিজ্যের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করেন নাই। উলটো সবাই বর্তমান প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ডা: মিজানুর রহমান বলেন, আমি বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। গণবিপ্লবের এ সরকার না আসলে হয়তো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া হতো না। আজীবন পাহাড়ের সীমান্তেই থাকতে হতো। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোভিড হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে ভেবেছিলাম ট্রেনিং পোস্টে পোস্টিং পাবো। কিন্তু সে সময়ের স্বাস্থ্য প্রশাসন আমাকে উলটো দুর্গম এলাকায় পাঠিয়ে আমার শিক্ষাজীবন ধ্বংস করে দেয়। আমার সাথে যারা চাকরি করতেন তারা কিছুদিন পর ভালো পোস্টিং নিয়ে চলে আসতেন। শুধু আমি একা দিনের পর দিন কাজ করে গেছি। মাঝে মধ্যে হতাশায় ভুবে গেছি। চাকরি ছাড়ার চিন্তাভাবনাও করেছি। আমি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির কাছে কৃতজ্ঞ। তারা স্বাস্থ্য খাতের বদলি বাণিজ্যের সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছেন। যাদের মামা-চাচা কেউ নাই তাদের জন্য কাজ করছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা