টঙ্গীতে পিডিবির ৫ প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্রই ফ্যাসিবাদের থাবা
- শেখ আজিজুল হক গাজীপুর মহানগর
- ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:৪৩
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) শত শত কোটি টাকা লুট করেছে ফ্যাসিবাদ সরকারের তিন স্তরের সিন্ডিকেট। প্রথম বা উচ্চ পর্যায়ের সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য গণ-অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় স্তরের সিন্ডিকেট অনেকটাই ভেঙে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু তৃতীয় স্তরের সিন্ডিকেট এখনো বহাল তবিয়তে আছে।
টঙ্গী ৮০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় ভাণ্ডার, কেন্দ্রীয় সরঞ্জাম মেরামত কারখানা, আঞ্চলিক সরঞ্জাম মেরামত কারখানা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ দেশের সর্বত্রই এই সিন্ডিকেটের থাবা বহাল আছে। বিএনপি আমলে স্থাপিত টঙ্গীর ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ পিডিবির বেশ কয়েকটি পাওয়ার স্টেশন বন্ধ রেখে নিজস্ব লোকদের বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) থেকে ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছে চক্রটি। তারা নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে পিডিবিকে এখনো পরনির্ভরশীল করে রাখতে তৎপর রয়েছে। পিডিবির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার আইন সংশোধন করে বিদ্যুৎ খাতে নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট চালায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সম্প্রসারণ আইন ২০১০ (সংশোধিত) এর আওতায় বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ অন্তর্ভুক্ত, অধিকাংশ ক্রয় চুক্তিতে ডলারে অর্থ পরিশোধ, বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎ কেনা, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে মালামাল কিনে চক্রটি লুটপাটের মহোৎসব করেছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খুচরা গড় মূল্য ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। তাদের লুটপাটের কারণে বর্তমানে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সায়। প্রায় আড়াই গুণ দাম বাড়ানো হলেও এ খাতের লোকসান ঠেকানো যাচ্ছে না। পিডিবির অর্থপরিদফতর অসৎ উদ্দেশ্যে ঠিকাদারদের বিল দীর্ঘদিন আটকে রাখার পরে ডলারের বর্ধিতমূল্যে বিল পরিশোধ করায় লোকসানের পাল্লা বেড়েই চলেছে। ফ্যাসিবাদ সরকারের তিন স্তরের সিন্ডিকেটের প্রথম স্তরে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবার, জ¦ালানি উপদেষ্টা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সচিব, এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, হোসাপ এনার্জি প্যাকসহ উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী মহল। দ্বিতীয় স্তর বা মধ্যম পর্যায়ের সিন্ডিকেটে ছিল বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ, পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান-মেম্বার, বিভিন্ন দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও নিয়ন্ত্রক (হিসাব ও অর্থ) এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওকুলান টেক বিডি, ওয়েবার লিমিটেড, ভারচ্যু লিমিটেড, বিএমআইটি লিমিটেড, জেঅ্যান্ডসি এনরিচ লিমিটেড, আইডিয়াল লিমিটেড ও কনফিডেন্স লিমিটেড ইত্যাদি। তৃতীয় স্তর বা পর্যায়ের সিন্ডিকেটে রয়েছে সিএসও টু চেয়ারম্যান, পরিচালক (অর্থ), উপসচিব ও পরিচালক (অডিট) উপ-পরিচালক (ফান্ড)।
গণ-অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময়ে প্রথম দুটি সিন্ডিকেট প্রায় ভেঙে গেলেও তৃতীয় স্তরের সিন্ডিকেট এখনো তৎপর রয়েছে। তাদের মধ্যে একই পদে সিএসও টু চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান ৪ বছর ৯ মাস, পরিচালক অর্থ হাবিব উল্লাহ ৪ বছর, উপ-সচিব আব্দুল হালিম ৯ বছর ১ মাস, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পরিচালক (অডিট) রুহুল কবীর অর্থ পরিদফতরে ছিলেন টানা ৯ বছর, সহকারী পরিচালক পদ হতে পদোন্নতি পেলেও নূরুস ছাফা উপ-পরিচালক (ফান্ড) পদে একই দফতরে ৮ বছর ও উপ-পরিচালক (ফান্ড) মেহবুব মোরশেদ ৭ বছর যাবত বহাল তবিয়তে আছেন। পিডিবিতে বঙ্গবন্ধু কর্মকর্তা পরিষদের সভাপতি নাছরুল হক (নিয়ন্ত্রক, হিসাব ও অর্থ) ও সাধারণ সম্পাদক পরিচালক (অডিট) রুহুল কবিরের নেতৃত্বে নন টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের আরো একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন যাবত বোর্ডের লোভনীয় অর্থপরিদফতরে কর্মরত আছেন। এই সিন্ডিকেটের সুবিধাভোগী উপ-পরিচালক (সিএসডি) পান্না কুমার ঘোষ ২০১৪ সাল থেকে এখনো পিডিবির টঙ্গীস্থ কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারে বহাল তবিয়তে আছেন।
সূত্র জানায়, আলোচিত সিন্ডিকেট শতকরা দুই ভাগ কমিশনে (ঘুষে) আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মালিকানাধীন দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকগুলোতে পিডিবির স্থায়ী জামানতের টাকা জমা রাখায় এসব অর্থ এখন ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে একধরনের অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা এসব অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৮১৭ দশমিক ২ কোটি টাকা। আলোচিত সিন্ডিকেটের কাছে ঠিকাদাররাও জিম্মি। তাদেরকে শতকরা দুই ভাগ কমিশন (ঘুষ) দিয়ে বিল ছাড় করাতে বাধ্য হন ঠিকাদাররা। এই কমিশন আদায় অবাধ ও নির্বিঘœ করতে পিডিবির আর্থিক ক্ষমতাঅর্পন বিধি লঙ্ঘন করে নাছরুল হক (নিয়ন্ত্রক, হিসাব ও অর্থ) তার অধঃস্তন পদের ক্ষমতা অর্থাৎ পরিচালক (অর্থ) এর ক্ষমতাও নিজ হাতে নিয়ে নেন। তিনি একই সাথে পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক পদের ক্ষমতা ব্যবহার করায় বিল ছাড়ে ঠিকাদাররা তার কাছেই ধরনা দিতে বাধ্য হন।
এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক (হিসাব ও অর্থ ) মো: নাছরুল হক বলেন, তিনি কোনো রকম অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতির সাথে জড়িত নন। হিসাব ও অর্থ শাখায় কোনো সিন্ডিকেট নেই। তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক যথারীতি কাজ করেন।