১৬ বছরে অর্গানোগ্রামের অর্ধেকও বাস্তবায়ন হয়নি, প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির মহোৎসব
- সরকার মাজহারুল মান্নান রংপুর ব্যুরো
- ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০২:০৬
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৬তম বার্ষিকী আজ। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরের অর্গানোগ্রামের অর্ধেকই বাস্তবায়ন হয়নি বিগত সময়ে। এই সময়ে ৪৭টি বিভাগ থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ২২টি বিভাগ। ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দেয়া ১০৩ কোটি উন্নয়ন বাজেট ছাড়া কোনো বরাদ্দও দেয়া হয়নি। শিক্ষা-গবেষণায় কোনো র্যাংকিং আনতে না পারলেও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগবাণিজ্য, অনিয়ম, দুর্নীতি আর বৈষম্যে হয়েছে সেরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আবু সাঈদের আত্মত্যাগের স্পিরিটে বিশ্ববিদ্যালয়টির বৈষম্য দূর করার আকাক্সক্ষা শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকতা-কর্মচারীদের। আজ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. লুৎফর রহমানকে প্রথম ভিসি নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়। রংপুর মহানগরীর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে স্থায়ী ক্যাম্পাসে ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল ৩০০ শিক্ষার্থী ও ১২ জন শিক্ষক নিয়ে শুরু হয়ে ছিল পাঠদান। ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি কারমাইকেল কলেজের ৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু হয়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নাম পরিবর্তন করে রাখেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয় ড. লুৎফর রহমানকে। এরপর চারজন ভিসি দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টি। একাডেমিক ও গবেষণা কার্যক্রমের বদলে শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ এবং অবকাঠামো নির্মাণে দুর্নীতি অনিয়ম স্বেচ্ছাচারিতা, পারিবারিকীকরণ, পীরগঞ্জিকরণ, ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে বারবার গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। নজিরবিহীন আন্দোলনের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থেকেছে মাসের পর মাস। গত ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের সামনে বুক পেতে দিয়ে গুলি বরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের মাস্টার্সের ফলপ্রার্থী শিক্ষার্থী আবু সাঈদের শাহাদাতের ঘটনায় বিপ্লবের অন্যতম প্রতিক হিসেবে দেশ-বিদেশে নাম ছড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টির। ৫ আগস্ট তৎকালীন সরকার প্রধানের পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর নতুনভাবে বৈষম্যহীন রূপান্তরের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১৮ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠ ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষক ড. শওকাত আলী। যোগদানের ২১ দিনের মাথায় আজ পালন হচ্ছে ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ বছরের একটি অর্গানোগ্রাম করা হয়। কিন্তু ১৫ বছরে বাস্তবায়ন হয়েছে অর্ধেকেরও কম। ওই অর্গানোগ্রামে ছিল ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যেই এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রতিষ্ঠিত হবে আট অনুষদ, ৪৭ বিভাগ। কিন্তু আদতে হয়েছে ৬ অনুষদ ২২ বিভাগ। এই সময়ে ৮১৯ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও আছে ২০৫ জন। শিক্ষার্থী থাকার কথা কমপক্ষে ১১ হাজার ৪৬৬ জন। কিন্তু আছে ৮ হাজারেরও কম। কর্মকর্তা কর্মচারী ১ হাজার ২০ জন থাকার কথা থাকলেও আছে ৬২২ জন। শিক্ষার্থীদের জন্য ৯টি হলো হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র হয়েছে তিনটি। আটটি একাডেমিক বিল্ডিং হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে অর্ধেক। জিমনেশিয়াম, টিএএসসি হওয়ার কথা থাকলেও সেগুলোর নামও এখনো শোনেন এখানকার শিক্ষার্থীরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দেয়া ১০৩ কোটি উন্নয়ন বরাদ্দ ছাড়া আর কোনো বরাদ্দও আসেনি এখানে। সব সঙ্কটে দিশেহারা শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক শামসুর রহমান সুমন জানান, গত ১৬ বছরে এখানে শুধু হয়েছে অনিয়ম দুর্নীতি, দলাদলি আর খেয়ালিপনা। বিশেষ করে শিক্ষক ও কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগে নজিরবিহীন অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। ফলে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম এগোয়নি সেভাবে। নেই অবকাঠামো। হল, বাস সহপ্রত্যেকটি কোনো কিছুই নেই। হয়েছে সর্বক্ষেত্রে শুধুই বৈষম্য। দেয়া হয়নি কোনো উন্নয়ন বরাদ্দ। যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা শুধু ফ্যাসিস্ট সরকারের তোষামোদি করেছেন। কোনো বরাদ্দ আনার চেষ্টা করেননি। বরং যে বরাদ্দ ছিল তাও লুটপাট করে খেয়েছেন। এখন সময় বদলেছে। আমাদের সহপাঠী বড় ভাই আবু সাঈদ জীবন দিয়ে বলে গেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির বৈষম্য দূর করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোরশেদ উল আলম রনি জানান, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পদোন্নতি নিয়োগ সব জায়গায় ১৬ বছরে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি বৈষম্য হয়েছে। আবু সাঈদ বৈষম্যের বিরুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। আমরা চাই এসব বৈষম্য দূর করে প্রশাসনকে দুর্রীতিমুক্ত করে জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির নবনিযুক্ত ভিসি ড. শওকাত আলী জানান, একটি ভঙ্গুর বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছি আমি। যার উন্নয়নে বিগত প্রশাসনের কেউ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। প্রতিষ্ঠাকালীন উন্নয়ন বরাদ্দ ছাড়া আনা হয়নি কোনো উন্নয়ন বরাদ্দ। আমি প্রথমে এসেই হল খুলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম রান করেছি। এখন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় ক্যাম্পাস মুখরিত। এর পাশাপাশি শহীদ আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। পূজার পর কমিটি প্রতিবেদন দিবে। এরপর এ বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় বাদি হয়ে মামলা করবে। এর পাশাপাশি অর্গানোগ্রাম, মাস্টার প্লান তৈরি করার কাজে হাত দিয়েছি। প্রত্যেকটি সেক্টরে অনিয়ম, দুর্নীতি বৈষম্য এবং উন্নয়ন না হওয়ার পেছনের কারণ অনুসন্ধান এবং প্রত্যেকটি জায়গায় কার্যকর কাজ করার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছি। অনিয়মের সাথে জড়িতদের বের করে আইনের মুখোমুখি করতে চাই। আমি চাই প্রতিষ্ঠাকালীন ভিসি ড. লুৎফর রহমানের পরিকল্পনার সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের কাছে পরিচিতি করতে। এজন্য প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টাসহ সব স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেতে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মহানায়ক আবু সাঈদের আত্মত্যাগের স্পিরিটকে মুখ্য করে কাজ করতে চাই।