সিসা কারখানার ধোঁয়ায় বিষাক্ত কামরাঙ্গীরচর
শ্বাসকষ্টের রোগী বাড়ছে, ঝুঁকিতে শিশুরা- শামীম হাওলাদার
- ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানা এলাকার মুসলিমবাগে ব্যাটারি ও ক্যান পুড়িয়ে সিসা তৈরি কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ায় নাকাল লক্ষাধিক মানুষ। এলাকার ঘরে ঘরে এখন শ্বাসকষ্টের রোগী। এমন বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলেই মারধর ও বসবাস করতে না পারার ভয়ে নীরবে কাঁদছে এলাকাবাসী। অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ অধিদফতর, থানা পুলিশ ও স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা এসব কারখানা থেকে নিয়মিত বখরা নিচ্ছে।
জানা গেছে, মুসলিমবাগে গত ৩৫ বছর ধরে সোনামিয়া মাস্তানের একটি সিসা কারখানার ধোঁয়ার অন্ধকারে বসবাস করছে স্থানীয় মানুষ। ময়লার ডাম্পিং থেকে কুড়ানো অকেজো ব্যাটারি ও বিভিন্ন কোম্পানির কোমল পানীয়ের ক্যানসহ দেশী-বিদেশী নানা ক্যান পুড়িয়ে ধাতব পদার্থ (সিসা) সংগ্রহ করা হয়। আর এ কারখানার ধোঁয়ায় মানুষ অতিষ্ঠ। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে মারধর ও মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করেন সিসা কারখানার বর্তমান মালিক ও সোনামিয়ার নাতি ইয়াসিন। তার বাবা ইউসুফ মাস্তান।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সোনামিয়া মাস্তান একসময় টোকাই ছিল। সে পুরানো ব্যাটারি সংগ্রহ করে পুড়িয়ে এক ধরনের ধাতব পদার্থ বের করে তা অন্যত্র বিক্রি করত। পরে তার ছেলে ইউসুফ এই কাজের হাল ধরলে একপর্যায়ে বড় কারখানা গড়ে তোলে। এখন কারখানার মালিক সোনামিয়ার নাতি ইয়াসিন। তারা আরো বলেন, গত ৩৫-৪০ বছর আগে সিসা কারখানাটির আশপাশে তেমন কোনো বসতি ছিল না। তাই কেউ কোনো প্রতিবাদ করত না। এখন এক লাখের বেশি মানুষ বসবাস করছে এই এলাকায়। তার মধ্যে ভোটার প্রায় ১২ হাজারের মতো। তাছাড়া এখানকার বেশির ভাগ মানুষ দিনমজুর হওয়ায় ভয়ে কেউ প্রতিবাদের সাহস পান না।
সিসা কারখানাটি মুসলিমবাগের মাস্তান ঘাট ঠোঢায় অবস্থিত। দিনে শ্রমিকরা ব্যাটারি ভাঙার কাজ করলেও রাতে বেশ কয়েকটি বড় চুল্লিতে ওই সব ভাঙ্গারি পুড়িয়ে তৈরি করা হয় সিসা। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিষাক্ত সালফিউরিক অ্যাসিডসহ ব্যাটারির ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র। লোহার মোটা ছুরির সাহায্যে আলাদা করা হচ্ছে প্লাস্টিক ও সিসা। এভাবেই অবাধে চলছে কারখানায় সিসা তৈরির কাজ। আর এসবের বর্জ্য ফেলছে বুড়িগঙ্গায়।
এদিকে কারখানার পশ্চিমে খেলার মাঠ, পূর্বে বসতবাড়ি, উত্তরে খাল ও শহর, দক্ষিণে বসতবাড়ি ও বুড়িগঙ্গা নদী। কারখানার আশপাশের বাড়িওয়ালা ইসমাইল, মোহাম্মাদ আলী, কালু দেওয়ান, মনির সুবেদার, সহিদুল্লা, হোসেন মিয়া, রাজা মিয়া, নুরু হাজী, হাফেজ বদু, সিরাজুল ইসলাম, অহিদ, সাহজান মিয়া, হাজী জাবেদ মিয়া, মুনছুর, মোশারফ, ইদ্রিস মিয়া, চুন্নু মিয়াসহ একাধিক বাসিন্দা এ প্রতিবেদককে বলেন, সিসা কারখানার বিরুদ্ধে কথা বললেই তাদের বিপদ ডেকে আনার মতো অবস্থা। তাছাড়া পুলিশ ও পরিবেশ অধিদফতরের লোকজনকে জানানোর পরে তারা ম্যানেজ হয়ে অভিযোগকারীর নাম বলে দেয়। এতে অভিযোগকারীসহ তার আত্মীয়স্বজনরা বিপদে পড়ে। তারা বলেন, সিসা ফ্যাক্টরির কারণে গাছপালার পাতা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। কোনো গাছে ফল ধরলেও তা পড়ে যায়। তাছাড়া নানা রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। এছাড়া ব্যাটারি বর্জ্য পোড়ানোর সময় যে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়, তা গাড়ির ধোঁয়ার চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর বলে জানান তারা।
ওই সিসা কারখানার এক কর্মী জানান, ব্যাটারির বর্জ্য বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাকে কারখানায় আনা হয়। তিন মণ বর্জ্য থেকে দেড় থেকে দুই মণ সিসা তৈরি হয়। প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করছে। তাছাড়া এখানে কাজ করার ফলে অনেক সময় শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। মাঝে মধ্যে শরীরও চুলকায়। তবে অভাবী ও গরিব মানুষ হওয়া ও বাসা এখানে থাকায় অন্য কোনো কাজ করছি না।
শিশু বিশেষজ্ঞ ও শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার জাহাঙ্গীর আলম এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, সিসা কারখানার ধোঁয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। এটা মানুষের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলছে। তাই ছয় বছরের নিচের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে মানসিক বিকৃতি, শ্বাসকষ্ট, রক্তশূন্যতা ও মস্তিষ্কের নানা ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। তিনি বলেন, সিসা কারখানার নির্গত গ্যাস বড়দেরও শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এমনকি কোনো পশুপাখি ওই কারখানার আশপাশের ঘাস খেলে অসুস্থ কিংবা মারাও যেতে পারে। অবৈধভাবে চলমান কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আমরা দীর্ঘ মেয়াদে চরম ঝুঁকিতে পড়ব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর মহাপরিচালক ডক্টর আবদুল হামিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, অবৈধ সিসা কারখানা কখনোই ঘনবসতি এলাকায় গড়ে ওঠতে পারে না। ওই কারখানার ঠিকানা দেয়া হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।