পাঠ্যবই সংশোধনে জন আকাক্সক্ষা পূরণ না হলে প্রত্যাখ্যানের হুঁশিয়ারি
- শাহেদ মতিউর রহমান
- ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
- পরিমার্জন কমিটির বিতর্কিত ব্যক্তিদের অপসারণ দাবি
- প্রয়োজনে এনসিটিবি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি
ধোঁয়াশা নিয়েই এগিয়ে চলেছে বিতর্কিত কারিকুলামের পাঠ্যবই সংশোধন-পরিমার্জনের কাজ। পরিমার্জনের জন্য গঠিত মূল কমিটির সদস্যদের নিয়ে সমালোচনা হলেও তারা এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। এ দিকে নামমাত্র সংশোধন বা পরিমার্জন করে নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য পাঠ্যপুস্তক মূদ্রণের কাজেও তোড়জোড় করা হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ে কী কী ধরনের পরিবর্তন বা পরিমার্জন হচ্ছে সে বিষয়েও প্রকাশ্যে কোনো তথ্য না এলেও আগামী ১৫ তারিখের মধ্যে বই মূদ্রণের কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
ওদিকে নামে মাত্র সংশোধন হয়ে পাঠ্যবই শিশুদের হাতে দেয়া হলে তা প্রতিহত করার আন্দোলন হতে পারে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বিভিন্ন সংগঠন, রাজনৈতিক দল এবং শিক্ষক ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে সরকারকে সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। এমনকি দেশের আলেম ওলামাদের পক্ষ থেকে দেয়া আলটিমেটাম শেষ হলে আগামী ৬ অক্টোবর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিরও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
এ দিকে পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করা হলেও পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে এখনো সরাসরি কাজ করেছেন বিতর্কিত ব্যক্তিরাই। তাই তাদের হাতে পাঠ্যবই কী ধরনের সংস্কার হবে তা নিয়ে সংশয়ে আছেন সচেতন মহল। এই কমিটির বিতর্কিত ব্যক্তিদের কমিটি থেকে অপসারণের দাবি আগেই করেছেন আলেম সমাজ। জাতীয় ওলামা মাশায়েখ ও আইম্মা পরিষদের নেতৃবৃন্দ গত ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন। সেখানে বক্তব্য রাখেন মুফতি হেমায়েত উল্লাহ কাসেমী, মুফতি আবদুল আজিজ কাসেমী, মুফতি ফরিদুল ইসলামসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। তারা পাঠ্যবই সংশোধনে দেশের তৌহিদি জনতার ইচ্ছার প্রতিফলন না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। অন্য দিকে হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দও শুরু থেকেই বিতর্কিত ব্যক্তিদের কমিটি থেকে বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। বিভিন্ন ইসলামিক দলের পক্ষ থেকেও পাঠ্যবই সংশোধন বা পরিমার্জনে সর্বজনবিদিত ব্যক্তিদের দ্বারা কমিটি গঠনের কথা বলে আসছেন।
গতকাল সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে পাঠ্যপুস্তক সংস্কার এবং এ সংক্রান্ত কমিটির কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন দেশের বিশিষ্ট আলেম সমাজ। সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পাঁচ দফা দাবিও তুলে ধরেন তারা। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইসলামিক স্কলার প্রফেসর ড. মুখতার আহমেদ, শায়খ আব্দুল হাই মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা রেজাউল করিম আবরার, শরীফ আবু হায়াত অপু এবং ডা: মেহেদি হাসান, মাওলানা সাইমুম সাদি, মুফতি সাইফুল ইসলাম প্রমুখ।
সাংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় শহীদের রক্তে পাওয়া গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গণমানুষের মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকবে সেটাই ছিল কাক্সিক্ষত। কিন্তু চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষী মহল ও সমকামিতার প্রকাশ্য সমর্থকদের নিয়ে গঠিত পরিমার্জন কমিটি দেখে ইসলামপন্থী জনতা চরমভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। সচেতন নাগরিক সমাজ মনে করে, বিগত শাসনামলে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী ছিল ইসলাম বিদ্বেষীরা। গণমানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন সরকারকে বিপাকে ফেলতে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে তারা পরিকল্পিতভাবেই এসব করছে।
এ ছাড়া সম্প্রতি এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী মহল’ আখ্যা দেয়ায় তীব্র নিন্দা জানানো হয়। তার এই বক্তব্যকে ‘ফ্যাসিবাদী’ এবং ‘ইসলামবিদ্বেষ-প্রসূত’ আচরণ বলে উল্লেখ করা হয়। সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দেয়া পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ও শিক্ষাবিদের দ্বারা পাঠ্যবই পর্যালোচনা করে ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংবেদনশীল বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সংশোধন করতে হবে। এমন কোনো ভিনদেশী মতাদর্শ প্রচার করা যাবে না, যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি এবং ঈমানী মূল্যবোধকে আঘাত করে। ‘অখণ্ড ভারতের’ মতো চরম সাম্প্রদায়িক বয়ান বাদ দিয়ে সঠিক ইতিহাস তুলে আনতে হবে এবং গণমানুষের চাহিদার আলোকে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতিফলন থাকবে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. কুরবান আলী নয়া দিগন্তকে বলেন, অনেক ত্যাগ আর জীবনের বিনিময়ে জুলাই-আগস্টের বিপ্লব এবং পরবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সরকারকে অবশ্যই জনমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বিশেষ করে পাঠ্যবই নিয়ে আগে থেকেই এ দেশের সাধারণ জনগণ শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ ছিল। এ দেশের মুসলমান এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথেও সেই কারিকুলাম ছিল সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তাই এখন সময় এসেছে সব কিছু পুনরায় ঢেলে সাজানোর। কিন্তু তার পরেও দেখা যাচ্ছে একটি মহল আবারো আওয়ামী লীগের এবং ইসলামবিদ্বেষীদের মদদপুষ্ট হয়ে পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের নামে বিতর্কিত বিষয়গুলোকেই পুনর্জীবিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের বক্তব্যও স্পষ্ট, পাঠ্যবইয়ে এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন না ঘটলে প্রয়োজনে পাঠ্যবই প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা দেয়া হবে।
অন্য দিকে এনসিটিবি থেকে জানানো হয়েছে, এ বছর পাঠ্যপুস্তকে আমূল কোনো পরিবর্তন আসছে না। শুধু ইতিহাসের অতিরঞ্জিত বিষয়গুলোই কেবল পরিমার্জন করা হবে। এ ছাড়া এ বছর সময়ও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ২০২৫ সালে নতুন পাঠ্যবই রচনার জন্য নতুন করে পরিমার্জন বা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হবে।