২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হাজার দর্শকের করতালিতে কাঁদলেন বাঁধন

আজমেরী হক বাঁধন
হাজার দর্শকের করতালিতে কাঁদলেন বাঁধন - ছবি : সংগৃহীত

এখন একটি সিনেমা মুক্তির পর হলে প্রথম শোতে কতজন দর্শক আশা করা হয়? প্রশ্নটি যদি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে হয় উত্তর হবে এক-দেড়শ। আর যদি বাংলাদেশী ছবি বিদেশী কোনো প্রদর্শনীতে হয় তাহলে তো দর্শক আরো কমে যাবে। কিন্তু চলচ্চিত্রের বিশ্বকাপখ্যাত কান উৎসবে বাংলাদেশের ছবি রেহেনা মরিয়ম সব হিসাব উল্টে দিয়েছে। ৭৪তম আসরের আঁ সার্তে রিগা বিভাগে প্রথম প্রদর্শনীতে এক হাজার ৬৮ জন দর্শক পিনপতন নীরবতায় সিনেমাটি উপভোগ করেন।

আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নির্মিত ছবিটি দেখতে আগে থেকেই বেশ লম্বা লাইন ছিল ডেবুসি হলের সামনে। প্রদর্শনীতে সিনেমাটির পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ ছাড়াও অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন, ছবিটির সিঙ্গাপুরের প্রযোজক জেরেমি চুয়া, চিত্রগ্রাহক তুহিন তমিজুল, প্রডাকশন ডিজাইনার আলী আফজাল উজ্জল, শব্দ প্রকৌশলী শৈব তালুকদার, কালারিস্ট চিন্ময় রয় এবং নির্বাহী প্রযোজক এহসানুল হক বাবু উপস্থিত ছিলেন।

দর্শক প্রতিক্রিয়ায় অভিভূত রেহানা মরিয়ম নূর চরিত্র রূপদানকারী অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন এ সময় আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন। গণমাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বাঁধন বলেন, ‘এখানে আসার মতো এত বড় স্বপ্ন দেখার সাহসও আমার ছিল না। যে সম্মান পেলাম তার পুরো কৃতিত্ব টিমের ও পরিচালকের। আমি শুধু তাকে বিশ্বাস করেছি আর তার কথামতো পরিশ্রমটা করেছি। আজ যে রেসপন্স পেয়েছি, আমি জানি না এরপর আমার আর কী পাওয়ার থাকতে পারে।’

দর্শক যখন দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছিল, সে মুহূর্তের অনুভূতি সম্পর্কে বাঁধন বলেন, ‘এত সম্মান, আমি জানি না...আমি সত্যিই সম্মানিত, অনেক আনন্দিত। এই সম্মানটা শুধু তো আমাদের নয়, আমাদের দেশের সম্মান। সবাই যখন দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল, তখন...আসলে তো আমরা আমাদের দেশটাকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। এটা দেশের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।’

এই উৎসবে আর কী প্রত্যাশা করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে বাঁধন বলেন, ‘এত দূর আসতে পেরেছি, সেটাই অনেক। এর পরও যদি কিছু নিয়ে দেশে ফিরতে পারি...এর চেয়ে তো বড় প্রাপ্তি আর থাকে না।’

এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে চলচ্চিত্রটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হলো। প্রদর্শনীর আগে পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ দর্শকদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। এমনিতেই সাদ খুব বলিয়ে-কইয়ে নন, তার ওপর এখানে ভাষা বলতে শুধুই ফ্রেঞ্চ। কোনোমতে ইংরেজিতে বললেন, কানে এসেছেন সেটা এখনো তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না। অবিশ্বাসীর মতোই তাকাচ্ছিলেন প্রায় পূর্ণ ডেবুসির দিকে।

এই উৎসবে যোগ দেয়া একজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, সিনেমাটির প্রদর্শনী শেষে তিনি দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দর্শকরা একবাক্যে সিনেমাটি নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। ইংরেজি সাবটাইটেল দেয়া ছবিটি বুঝতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি বলেও জানিয়েছেন। হলভর্তি পুরো অডিয়েন্স যেভাবে বাংলাদেশের সিনেমাটিকে স্বাগত জানিয়েছে, তা অভাবনীয়।

কান চলচ্চিত্র উৎসবকে ‘সিনেমার অলিম্পিক’ হিসেবেও ধরা হয়। দক্ষিণ ফ্রান্সের কান শহরের সাগর উপকূলে পালে দে ফেস্টিভাল ভবনে গত মঙ্গলবার ৭৪তম উৎসবের পর্দা উঠেছে। উৎসব চলবে ১৭ জুলাই পর্যন্ত।

উৎসবের মূল পর্বে দেখানো হবে ৪৪টি চলচ্চিত্র। প্রতিযোগিতা বিভাগে ২৪টি। আঁ সার্তে রিগা বিভাগে ২০টি চলচ্চিত্র স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’।

একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক রেহানা মরিয়ম নূরকে কেন্দ্র করে সিনেমাটির গল্প। কর্মস্থলে ও পরিবারে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাঁকে। শিক্ষক, চিকিৎসক, বোন, কন্যা ও মা হিসেবে জটিল জীবন যাপন করেন তিনি। এক সন্ধ্যায় একজন অধ্যাপকের কক্ষ থেকে এক ছাত্রীকে কাঁদতে কাঁদতে বের হতে দেখেন রেহানা। এ ঘটনার পর ক্রমে একরোখা হয়ে ওঠেন তিনি। ওই ছাত্রীর পক্ষ হয়ে সহকর্মীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। একই সময়ে তার ছয় বছর বয়সী মেয়ের বিরুদ্ধে স্কুল থেকে রূঢ় আচরণের অভিযোগ ওঠে। অনড় রেহানা তথাকথিত নিয়মের বাইরে গিয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রী ও নিজের মেয়ের জন্য ন্যায়বিচারের লড়াই করতে থাকেন।

একটি মেডিক্যাল কলেজে পুরো চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে। পুরো সিনেমাতেই এক ধরনের অনুজ্জ্বল নীলাভ-সাদা আলো বেছে নেওয়া হয়েছে। ভবনের ভেতরে বা বাইরে কোথাও কখনো উজ্জ্বল আলো দেখা যায়নি। আলো-আঁধারির যে খেলা সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা রেহানার গল্পের সাথেও মানানসই। পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও যত্ন করে আলোর বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে। কোনো চরিত্রই তেমন উজ্জ্বল কাপড় পরেনি। বরং সমাজে নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন এবং এ নিয়ে যে লুকোচুরি এবং হুশ-হাশ চুপ-চুপের অবতারণা করা হয়, সিনেমার লাইটিং তাকে দারুণভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ভালো একটি দৃশ্যের জন্য ক্যামেরার যে কয়টি নিয়ম মানার কথা বলা হয়ে থাকে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কোনোটির ধার ধারেননি সাদ। রেহানা মরিয়ম নূরে ট্রাইপড বা অন্য কোনো ডিভাইস ব্যবহার করে দৃশ্যকে স্থিতিশীল করার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি।

বাংলা ভাষায় নির্মিত এক ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের এই ছবিতে ইংরেজি সাবটাইটেল দেয়া হয়েছে। চলচ্চিত্রটি আগামী সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে মুক্তি দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন চলচ্চিত্রটির নির্বাহী প্রযোজক এহসানুল হক বাবু।

৩৭ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের হাত ধরেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে কোনো চলচ্চিত্র অফিশিয়াল সিলেকশনে জায়গা পেল। এর আগে ১৯৯৪ সালে ‘আঁ সার্তে রিগা’ বিভাগে ভারতীয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ‘উত্তরণ’ নির্বাচিত হয়েছিল। কানের অফিশিয়াল সিলেকশনের চার বিভাগের বাইরে প্যারালাল বিভাগের ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটে ২০০২ সালে উৎসবের ৫৫তম আসরে নির্বাচিত হয়েছিল প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’। ছবিটি সেবার পুরস্কৃত হয়েছিল।

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement