২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রিয়ার প্রতি ভারতীয় মিডিয়ায় 'শকুনের মত' আচরণ, বলিউডে ক্ষোভ

- ছবি : সংগৃহীত

বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের বান্ধবী ব্যাপকভাবে আলোচিত রিয়া চক্রবর্তীকে গ্রেফতার করেছে ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো এনসিবি। কিন্তু অভিনেত্রী রিয়াকে ভারতের সংবাদমাধ্যম যেভাবে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, হেনস্থা করেছে, যেভাবে তার দোষ প্রমাণিত হবার আগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলেছে তা নিয়ে সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন চলচ্চিত্র তারকারা।

সংবাদমাধ্যমে, বিশেষ করে কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে রিয়া চক্রবর্তীকে নিয়ে যে ধরনের কভারেজ দেয়া হচ্ছে, তাতে সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তেমনই বিচারের দায়িত্ব সঙ্গতভাবে আইনের হাতে তুলে দিতে তাদের ব্যর্থতা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন।

বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর তদন্তের অংশ হিসাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রোববার ভারতের নারকোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো এনসিবি যখন রিয়াকে ডেকে পাঠায়, তখন তিনি সেখানে পৌঁছলে সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক হুড়োহুড়ি ও ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়।

তিনি সাংবাদিকদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যেভাবে হয়রানির শিকার হন তার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বলিউড তারকা ও চলচ্চিত্র নিমার্তারা রিয়ার প্রতি ভারতীয় সাংবাদিকদের আচরণের বিরুদ্ধে সরব হন।

এনসিবি দফতরের বাইরে করোনা আবহে সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখার এবং রিয়া চক্রবর্তীকে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগও ওঠে।

এই ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মাও।

'সাংবাদিকতার পক্ষে একটা অশনিসঙ্কেত'
সুশান্তকে ১৪ জুন মুম্বাইতে তার ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশ বলে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

সিবিআই সুশান্তের বান্ধবী রিয়া এবং তার পরিবার ও আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা সহ ভারতীয় দণ্ডবিধির বেশ কয়েকটি ধারায় মামলা দায়ের করে।

তিনি দোষী কিনা তা নিয়ে আদালতের বিচার এখনো শুরুই হয়নি। এমনকি তদন্তের কাজ যখন প্রাথমিক পর্যায়ে তখনই সুশান্ত সিং রাজপুতকে আত্মহত্যায় প্ররোচণা দেবার দায়ে রিয়াকে রীতিমতো দোষী বানিয়ে ফেলেছে সামাজিক মাধ্যমের পাশাপাশি এক শ্রেণির গণমাধ্যমও।

টেলিভিশনের উপস্থাপকরা তাকে "ধান্দাবাজ" নারী বলে বর্ণনা করেছেন, যিনি "ডাইনি বিদ্যায় পারদর্শী" এবং বলেছেন "সুশান্তকে তিনি আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছিলেন"।

সিবিআই-য়ের হাতে এই মামলার তদন্তভার তুলে দেবার পর একটি টিভি চ্যানেলের সুপরিচিত একজন উপস্থাপক বলেন, "এটা ভারতের ইতিহাসে একটা অসামান্য মুহূর্ত"।

টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন শিখা মুখার্জি। তিনি বলেছেন, তার ৪০ বছরের সাংবাদিক জীবনে তিনি টিভি চ্যানেলগুলোকে "এভাবে একজনকে দোষী প্রমাণ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগতে দেখেননি"।

তিনি বলছেন প্রায় প্রতিদিন সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন রিয়া। তার ব্যক্তিগত জীবন এবং প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে যাবতীয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় চ্যানেলগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরছে এবং সেসব নিয়ে টিভিতে প্রকাশ্যে কাটাছেঁড়া চলছে, সেগুলো মুখরোচক আলোচনা আর বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।

"যেখানে পুলিশ, সিবিআই এবং বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে, সেখানে সাংবাদিক হিসাবে আমার কাজ হবে তদন্তে কী বেরিয়ে আসছে তা রিপোর্ট করা। তা না করে চ্যানেলগুলো নিজেদের আঁচ অনুমান, বা শোনা কথার ভিত্তিতে তথ্য দিচ্ছে, নানা অভিযোগ এনে সাজিয়ে গুছিয়ে এমনভাবে তথ্য পরিবেশন করছে যাতে মনে হবে সুশান্তের মৃত্যুর জন্য রিয়াই দায়ী।

"আমি বলব চ্যানেলগুলো খুবই ম্যানিপুলেটিভ কভারেজ দিচ্ছে, মানুষকে ভাবতে প্রভাবিত করছে যে রিয়া দোষী। এটা তো সংবাদ মাধ্যমের কাজ হতে পারে না," বলছেন শিখা মুখার্জি।

তিনি বলছেন রিয়া যদি দোষী হয়, সেটা তদন্তের ভিত্তিতে আদালতে প্রমাণিত হতে হবে।

আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইনের সম্পাদক অনিন্দ্য জানা বলেছেন রিয়াকে দোষী প্রমাণিত করার মধ্যে দিয়ে কিছু টিভি চ্যানেল "তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে।"

"সামনে বিহারের নির্বাচন এবং সুশান্ত সিং রাজপুত বিহারের ভূমিপুত্র। বিহারের ক্ষমতাসীন দল কেন্দ্রে বিজেপির শরিক এবং সেখানে নির্বাচনী প্রচারে সুশান্তের মৃত্যুর ঘটনাকে ব্যবহার করা হচ্ছে," বলছেন অনিন্দ্য জানা। "এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত কদর্য" বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

তিনি বলছেন "রিয়া দোষী কি দোষী না সেটা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু উইচহান্ট করে সেটা যেভাবে মিডিয়া ট্রায়ালের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটা সাংবাদিকতার পক্ষে একটা অশনিসঙ্কেত। "

যেটা পদ্ধতিগতভাবে ঘটছে সেটা রিপোর্ট করা সাংবাদিকের কাজ, তিনি বলছেন। কিন্তু যেটা আপত্তিজনক, সেটা হল তদন্তকে কোনো একটা পথে ঠেলে নিয়ে যেতে জেনেশুনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।

''খানিকটা নীতিনৈতিকতা রেখে খবরকে খবর হিসাবে তুলে ধরার যে সাংবাদিকতা, রিয়া চক্রবর্তীর খবর নিয়ে সংবাদমাধ্যমের আচরণ সেই সাংবাদিকতার জন্য শুভ সংবাদ বহন করে আনছে না।"

অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইতোমধ্যেই রিয়াকে "স্বার্থান্বেষী", "মাফিয়া চক্রের হোতা" এবং "ধনী পুরুষ ধরার যৌন ছিপ" বলে তকমা দিয়েছে।

বলিউডে ক্ষোভ
বলিউড তারকারা সংবাদমাধ্যমের এই আচরণকে "ন্যাক্কারজনক এবং জঘন্য" বলে মন্তব্য করেছেন।

অভিনেত্রী তাপসী পান্নু তার টুইটার অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, "এই সাংবাদিকরা একজন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার হিংস্রভাবে কেড়ে নিয়েছে, সে দোষী প্রমাণিত হবার আগেই "।

"আমি আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি এরা প্রত্যেকে যেন কর্মফল ভোগ করে, সবচেয়ে নিচু মানবিকতার যে দৃষ্টান্ত আমরা এদের মধ্যে দেখছি, ঈশ্বর যেন এদের প্রত্যেকের ঠিকানা খুঁজে, তাদের শাস্তি দেন।"

ভারতীয় প্রযোজকদের গিল্ড এক বিবৃতিতে বলেছে, "একজন তরুণ তারকার মর্মান্তিক মৃত্যুকে হাতিয়ার করে, গোটা চলচ্চিত্র শিল্প ও এর সাথে জড়িতদের সম্মান ধুলায় টেনে নামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে"।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে সিনেমা জগতকে বাইরের মানুষের কাছে একটা "কলঙ্কময় অন্ধকার জগত হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে যা শুধুই নির্যাতন আর অপরাধের একটা জগত "।

তেলেগু সিনেমার একজন অভিনেত্রী লক্শমি মাঞ্চু টুইট বার্তায় "এই আক্রমণ" বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন রিয়া এবং তার পরিবার এই "তথাকথিত মিডিয়া বিচারের" মুখোমুখি হয়ে কীভাবে জীবন কাটাচ্ছেন সেটা তিনি অনুমান করতে পারছেন।

অভিনেত্রী বিদ্যা বালান বলেছেন এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে রাজপুতের "মর্মান্তিক মৃত্যু" এখন একটা "মিডিয়া সার্কাসে" পরিণত হয়েছে।

"রিয়াকে যেভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, একজন নারী হিসাবে তা আমাকে ব্যথিত করেছে। আমরা জানি 'আপনি যতক্ষণ না দোষী প্রমাণিত হচ্ছেন- আপনি নির্দোষ' কিন্তু এখানে যেটা হচ্ছে সেটা হল 'আপনি এখন দোষী- যতক্ষণ না প্রমাণিত হচ্ছে আপনি নির্দোষ'।"

অভিনেত্রী দিয়া মির্জা টুইটারে বলেছেন, "সংবাদমাধ্যম এভাবে শকুনের মত আচরণ করছে কেন? রিয়াকে কেন তারা সময় দিতে চান না?"

আরেক অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করও বলেছেন, "সংবাদমাধ্যমকে ধিক্কার। আর আমরা যারা এসব সংবাদ গিলছি আমাদেরও লজ্জা পাওয়া উচিত।"

বিচারের দায়িত্ব
সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর কারণ এখনও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, কিন্তু মামলা আদালত পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই সংবাদ মাধ্যম তাকে দোষী রায় দিয়ে দিয়েছে, বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন উর্ধ্বতন আইনজীবী মিনাক্ষী অরোরা।

"এটা পুরো সংবাদমাধ্যমে বিচার চলছে। এই বিচারের দায়িত্ব কী মিডিয়ার নাকি আদালতের? মিডিয়া তাকে ইতোমধ্যেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছে- যেটা আইনত খুবই অন্যায়।"

আরেকজন আইনজীবী পায়েল চাওলা বলেছেন, "সংবাদমাধ্যমে, টিভিতে এধরনের রিপোর্টিং খুবই সমস্যার। এর মধ্যে দিয়ে দেখা গেছে একজন নারীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জনসমক্ষে কাটাছেঁড়া করা কত সহজ।"

সাংবাদিক শিখা মুখার্জি বলেছেন, "এটা ভারতীয় সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বড় প্রতিফলন। মেয়েদের বিশেষ ভাবে দেখার মানসিকতা আমাদের সংস্কৃতির একটা অঙ্গ।"

তবে তিনি বলছেন, সুশান্তের মৃত্যুর ঘটনায় রিয়ার ভূমিকা নিয়ে তাকে মিডিয়াতে হেনস্থা করার সুযোগটা কোন চ্যানেল কত বড় করে নেবে তার যেন প্রতিযোগিতা চলছে। ভারতে করোনাভাইরাস, অর্থনীতি এসব খবর পেছনে পড়ে গেছে। "চ্যানেলগুলোতে খবর এখন শুধু রিয়া চক্রবর্তী!" বলছেন শিখা মুখার্জি।

শুধু নারী বলে নয়, যে কোন অভিযুক্তের প্রকৃত বিচারের ভার আইনের হাতে তুলে দেবার আগেই সংবাদমাধ্যমের বিচারের একটা কাঠগড়া তৈরি করা, আর জনতার হাতে তার বিচার করার দায়িত্ব তুলে দেয়ার এই প্রবণতা সংবাদ মাধ্যমের জন্য যে বিরাট একটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় একথা অনেক বিশ্লেষকই বলছেন।

চাওলা বলছেন রিয়ার ন্যায় বিচারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এই "অন্যায় মিডিয়া ট্রায়ালের" বিষয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের কাছে বিচারও চেয়েছেন।

অবৈধ মাদকের সাথে যোগাযোগের অভিযোগে তাকে মঙ্গলবার গ্রেফতার করার আগে তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে একটি বিবৃতিও দিয়েছিলেন। বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement