২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

সিনহাকে হত্যাপরিকল্পনা সম্পর্কে রায়ে যা বলা হয়েছে

সিনহা মো: রাশেদ খান - ফাইল ছবি

কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবা নির্মূলের আড়ালে ওসি প্রদীপের ক্রসফায়ারে নিরীহ মানুষ হত্যা, ইয়াবা ও চোরাকারবার বাণিজ্য, সুন্দরী নারীদের ধর্ষণ এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করার ডকুমেন্টারি তথ্য সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো: রাশেদ খানের হাতে পৌঁছে যাওয়ায় তাকে হত্যার পরিকল্পনা নেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। সেকারণে প্রথমে মেজর সিনহাকে ডাকাত সাজিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল প্রদীপ-লিয়াকতরা। তাতে সফল না হয়ে সরাসরি গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তাদের ভাবনায় ছিল অন্য দশটি ক্রসফায়ারের মতো এই হত্যাকাণ্ডটিও মিথ্যা গল্প সাজিয়ে সামাল দিতে পারবেন কিন্তু হয়নি।

সিনহা হত্যা মামলায় মেজর সিনহার সহকর্মী প্রত্যক্ষদর্শী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের আদালতে দেয়া বক্তব্যে এই তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া সোমবার ঘোষিত রায়েও হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিচারক কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল রায় পড়ার সময় উল্লেখ করেন, ঘটনাস্থলে দায়িত্বপ্রাপ্ত যারা ছিলেন তারা সিনহাকে পরিচয় জেনে সেল্যুট জানিয়ে চলে যেতে বললেন কিন্তু তাদের আবার আটক করার প্রয়োজন হল কেন বা গুলি করার প্রয়োজন হলো কেন? এটা কী কোনো পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল? এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে রহস্যটা কী আমি চেষ্টা করেছি সেটা বের করতে। আপনারা লক্ষ্য করেছেন দুই পক্ষকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেছি কেন এই রকম ঘটনা ঘটলো? বিশেষ করে ৩৪২ ধারায় এসআই শাহজাহানকে জিজ্ঞেস করেছি এবং প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরাও বলছেন। দায়িত্বরতদের উদ্দেশ্যে বলেছি, ‘এই হত্যাকাণ্ডটা প্রতিরোধ করতে পারলেন না কেন? দায়িত্ব ছিল চেকপোস্টে আটকে রাখা। যদি তাই হতো এই দুঃখজনক ঘটনাও ঘটতো না এবং এই বিচারেরও প্রয়োজন হতো না। চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা এসআই শাহজাহান খুব চমৎকারভাবে উত্তর দিয়েছে আইসি লিয়াকত আলী পাশে একটা বটগাছের নিচে দাঁড়ানো ছিল এবং ওনি হঠাৎ ১০ থেকে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে গুলিটা করে ফেলেছেন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটছে। এতে পরিষ্কার এই হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত।

ঘোষিত রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান ২০১৮ সালে ব্যক্তিগত কারণে স্বেচ্ছাবসরে গিয়ে দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক, ভ্রমন ও পর্যটন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ডকুমেন্টারি ভিডিও চিত্র তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য তিনি ‘জাস্ট গো’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল প্রতিষ্ঠার কাজ করছিলেন। তারই ধারবাহিকতায় তিনি সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও আরো দুজন সহকর্মী নিয়ে ২০২০ সালের ৩ জুলাই কক্সবাজার আসেন। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে সাগর ও পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য্যে তিনি বিমোহিত হয়ে পড়েন। ধারণ করতে থাকেন নানা চিত্র।

বেশকিছু দিন তিনি কখনো পাহাড়ের চূড়ায় অথবা সমুদ্র সৈকতের দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সাথেও তার সখ্য গড়ে উঠে। কাজের ফাঁকে তিনি স্থানীয়দের দুখসুখের গল্প শোনেন। এসময় উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় ইয়াবা দমনের নামে ওসি প্রদীপের হত্যাযজ্ঞ চলছিল। স্থানীয় জনগণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মেজর সিনহা এবিষয়ে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে ওসি প্রদীপের ইয়াবা দমনের আড়ালে ইয়াবা বাণিজ্য, চোরাচালান ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায়ের তথ্য প্রমাণ পেয়ে যান। এতেই সংক্ষুব্ধ হয়ে রক্তনেশায় উন্মত্ত প্রদীপ মেজর সিনহাকে ক্রসফায়ারে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং বেছে নেন মুসলিমদের বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহার সময়টিকে।

প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের বরাতে বিচারক প্রদত্ত রায়ে উল্লেখ করেন, মেজর সিনহা ২০২০ সালের ৩১ জুলাই বিকেল ৪টার সময় সহকর্মী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে কক্সবাজারের রামু থানার হিমছড়িস্থ নীলিমা রিসোর্ট থেকে ডকুমেন্টারি ভিডিও চিত্র ধারণের জন্য মেরিন ড্রাইভ দিয়ে টেকনাফের বাহারছড়ার মারিশবুনিয়া গ্রামের মুইন্না পাহাড়ে গমন করেন। ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত তাদের পূর্বপরিকল্পনা ও নির্দেশনা মতে মোহাম্মদ আইয়াছ, মোহাম্মদ নুরুল আমিন ও মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন রাত ৮টার সময় মেজর সিনহা ও সিফাতকে ডাকাত সাব্যস্ত করে গণপিটুনি দেয়ার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ মারিশবুনিয়া জামে মসজিদের মাইকে পাহাড়ে ডাকাত দেখা যাচ্ছে বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু পাহাড়ে কোনো সাড়াশব্দ না দেখায় এবং মসজিদের ইমাম হাফেজ মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম উপস্থিত লোকজনদের মেজর সিনহার পরিচয় দেয়ায় লোকজন চলে যায়।

পরে মেজর সিনহা ও সিফাত ভিডিও চিত্র ধারণ শেষে প্রাইভেটকারে (নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-২৮-০৯৭৯) নিলীমা রিসোর্টের উদ্দেশে রওয়ানা হলে উক্ত মোহাম্মদ আইয়াছ, মোহাম্মদ নুরুর আমিন এবং মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন মেজর সিনহাদের অনুসরণ করে মেরিন ড্রাইভ সড়ক পর্যন্ত চলে আসে এবং তারা কোনদিকে যাচ্ছে তা নিশ্চিত হয়ে রাত ৮টা ৪৭ মিনিটের দিকে লিয়াকত আলীকে সেলফোনে জানায়। লিয়াকত আলী এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতকে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনামতে শাপলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে এসে অবস্থান নেন।

রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে মেজর সিনহার গাড়ি উক্ত চেকপোস্টে পৌঁছিলে লিয়াকত আলী ও নন্দ দুলাল সেখানে দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্য এসআই শাহজাহান আলী কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও রাজীব হোসেনের সহায়তায় মেজর সিনহার গাড়িতে ব্যারিকেড দিয়ে আটকায়। এসময় সিনহা নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর বলে পরিচয় দেন। এপিবিএনের সদস্যরা মেজর সিনহার পরিচয় পেয়ে তাকে সেল্যুট দিয়ে ছেড়ে দেন।

কিন্তু পরক্ষণেই লিয়াকত আলী ও নন্দদুলাল রক্ষিত গাড়ির সামনে পিস্তল তাক করে উত্তেজিত হয়ে মেজর সিনহাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে এবং গাড়ি থেকে নামতে বলে। তখন মেজর সিনহা ড্রাইভিং সিট থেকে দুই হাত উঁচু করে নেমে গাড়ি হেডলাইট বরাবর সামনে দাঁড়িয়ে লিয়াকতকে নিজের পরিচয় দিয়ে শান্ত হতে অনুরোধ করেন। কিন্তু লিয়াকত আলী পরিকল্পনামতো সিনহাকে প্রথমে দুই রাউন্ড এবং সামনে এগিয়ে আরো দুই রাউন্ড গুলি করলে সিনহা রাস্তায় পড়ে যান। এসময় লিয়াকতের নির্দেশে নন্দ দুলাল রক্ষিত গুলিবিদ্ধ মেজর সিনহাকে হ্যান্ডকাপ পরান এবং সিফাতকে রশি দিয়া বেঁধে ফেলেন।

লিয়াকতের সহযোগীরা এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর অবস্থায় পড়ে থাকা মেজর সিনহাকে যাতে কেউ সাহায্য করতে না পারে কিংবা ঘটনাস্থলের ভিডিও চিত্র ধারণ করতে না পারে সেভাবে ঘটনাস্থল পাহারা দিয়ে রাখেন।

রাত ৯টা ৩০ মিনিটে ও রাত ৯টা ৫৪ মিনিটের দিকে লিয়াকত মোবাইল ফোনে ওসি প্রদীপকে জানান এবং বলেন, ‘স্যার টার্গেট ডাউন করেছি এবং একজনকে ধরে ফেলেছি।’ রাত ১০টার দিকে প্রদীপ কুমার দাশ কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেবকে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে লিয়াকত আলীর সাথে কথা বলেন এবং গুলিবিদ্ধ মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে থাকা মেজর সিনহার কাছে যান। এসময় সিনহা প্রদীপের কাছে পানি চেয়ে প্রাণ বাঁচানোর আকুতি জানালে প্রদীপ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে মেজর সিনহাকে বুকের বামদিকে সজোরে লাথি মারেন এবং পায়ের বুটজুতা দিয়ে সিনহার গলায় চেপে ধরে বলেন, ‘শালা তোকে পানি দেয়ার জন্য গুলি করেছি?’

পরে মৃত্যু নিশ্চিত করে প্রদীপরা মেজর সিনহার নিথর দেহকে একটি মিনি ট্রাকে (ছারপোকা গাড়ি) ছুঁড়ে মারেন। ট্রাকটি মেজর সিনহাকে নিয়ে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চলে যায়। পরে ওসি প্রদীপ-লিয়াকতরা ঘটনাকে আড়াল করে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে ঢুকিয়ে চোখ বেঁধে নাকে মুখে পানি ঢেলে অমানবিকভাবে নির্যাতন করে। পরে সিফাতকে টেকনাফ থানায় নিয়ে গিয়ে সিনহার গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের সাজানো ও মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার দেখায়।


আরো সংবাদ



premium cement
রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে নিহত ৪, ১৪৪ ধারা জারি রাজধানীতে সংঘর্ষে ২ যুবক নিহত জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা তুলে ধরবেন ড. ইউনূস কুড়িগ্রামের উলিপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু তোফাজ্জল হত্যা : ঢাবির ৬ শিক্ষার্থীর দায় স্বীকার কুমিল্লা-১০ বিনির্মাণে আমাদেরকে কাজ করতে হবে : ইয়াছিন আরাফাত উন্নয়নের নামে দুর্নীতির মহোৎসবে মেতেছিল আ’লীগ : হামিদ আজাদ ভাইকে হত্যা করাতে ১৪ মাসের ষড়যন্ত্র ভান্ডালজুড়ি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে ঢাবি ও জাবিতে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে খুলনায় শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাংবাদিক রনো ও তার পরিবার

সকল