‘মনে হয় বোমাগুলো আমাদের গ্রামেই পড়তেছে’
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৭:৫৩
কয়েক দিন বিরতির পর আবারো গোলাগুলি শুরু হয়েছে টেকনাফের ওপারে। বৃহস্পতিবার রাতভর একের পর এক বিস্ফোরণের বিকট শব্দে স্থানীয়দের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
টেকনাফ সীমান্তবর্তী স্থানীয় বাসিন্দারা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তারা এত জোরালো শব্দ শোনেননি।
তাদের ভাষ্য হচ্ছে, দিনের বেলায় সবকিছু মোটামুটি শান্ত থাকলেও গত এক সপ্তাহের বেশি সময় যাবৎ সীমান্তের ওপার থেকে প্রতিরাতে বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। এর মাঝে গতকালের বিস্ফোরণ সবচেয়ে ‘ভীতিকর’ ছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, গতকাল প্রতিটি শব্দের পর টেকনাফ কেঁপেছে।
যা হচ্ছে টেকনাফে
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে আলাদা করেছে নাফ নদ। নদের এপারে বাংলাদেশের টেকনাফ। আর ওপারে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী রাজ্য রাখাইনের মংডু শহর।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার আর্মি ও বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সঙ্ঘাত দীর্ঘদিনের। তাদের মধ্যে সঙ্ঘাত যখনই জোরালো হয়, তখনই তা টের পায় বাংলাদেশও।
এই দফায়ও সেটি হয়েছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও কর্মকর্তারা। সেখানে দু’পক্ষের মাঝে এখন গোলাগুলি হচ্ছে, বিমান হামলা চলছে।
টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দা জাকারিয়া আলফাজের সাথে এ নিয়ে বিবিসি বাংলা’র কথা হয় শুক্রবার।
তিনি বলছিলেন, ‘বিমান হামলা হলে বিকট শব্দ হয়। এতে আমাদের মাটি, ঘর, বাড়ি পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। রাতে স্থানীয়রা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বাচ্চারা অনেক ভয় পায় তখন।’
‘গত সাত থেকে ১০ দিন ধরে বোমা বিস্ফোরণের অনেক বিকট শব্দ শোনা যায়। মনে হয়, বোমাগুলো আমাদের গ্রামেই পড়তেছে। ওইসময় মানুষের ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠে,’ তিনি বর্ণনা করেন।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার রাতেও তারা সাতটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন এবং নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, দিনেও কী একই রকম পরিস্থিতি থাকে?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘দিনে পরিবেশের অনেক শব্দ থাকে। তখন এই শব্দ বেশি প্রভাব ফেলতে পারে না। কিন্তু রাতে আর ভোরে যে বিস্ফোরণটা হয়, সেটা মারাত্মক।’
তারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন জানিয়ে তিনি যোগ করেন, ‘এই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। এটা যদি সাময়িক হতো, তাহলে তেমন উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয় ছিল না। কিন্তু এটি এখন নিয়মিত হচ্ছে।’
বৃহস্পতিবার রাতের পরিস্থিতি বর্ণনা করে কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক আজিম নিহাদ বিবিসি বাংলাকে জানান, ‘এই ধরনের বিকট শব্দ খুব একটা শোনা যায় নাই আগে।’
‘গতকাল রাতে ১১টা থেকে ১টার মাঝে টেকনাফের লোকজন শুনতে পেয়েছে,’ যোগ করেন তিনি। মংডু ও তমব্রু দুই সীমান্ত থেকেই বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে তিনি জানান।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ উল্লাহ নিজামীও বিবিসি বাংলাকে বলেন, গতকাল রাতে টেকনাফের চারপাশ বা সেন্টমার্টিনের আশপাশের এলাকা কেঁপে ওঠে।
‘মাঝখান থেকে বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। এখন আবার শোনা গেল। আমরা বিজিবির সাথে কথা বলে জেনেছি, সেখানে এয়ার স্ট্রাইক হয়েছে। আরাকান আর্মি ও জান্তা সরকারের সংঘর্ষ হচ্ছে।’
বিবিসি বার্মিজ সার্ভিস জানিয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্তে এখন বড় ধরনের কোনো সঙ্ঘাত চলছে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন সীমান্তে নেই বলে তিনি জানান। তাছাড়া মিয়ানমার নৌবাহিনীর কোনো জাহাজও এখন সীমান্তে নেই।
তবে টেকনাফ সীমান্তের কাছে মংডু টাউনশিপে মিয়ানমার বাহিনী কিছু বিমান হামলা চালিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আরাকান আর্মি যাতে সে এলাকা দখল করার জন্য অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য এসব বিমান হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি বার্মিজ সার্ভিস।
বাংলাদেশের জন্য যে ধরনের সমস্যা তৈরি হবে
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে দুই পক্ষের মাঝে ক্রমাগত ঝামেলা চললেও এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
তবে এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের জন্য সেটি 'সমস্যা হতে পারে' বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম।
বিবিসি বাংলার সাথে তার আলাপকালে ইসলাম বলেন, মিয়ানমারে এখন যে ধরনের সংঘর্ষ চলছে এবং মিয়ানমার আর্মি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে যে এটি একটি ‘স্মার্ট মুভ’ হবে।
মিয়ানমার আর্মি আরাকান আর্মিকে মোকাবেলা করার জন্য রোহিঙ্গাদেরকে নিয়োগ দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা রোহিঙ্গাদেরকে ‘কিছু অস্ত্র দিয়ে অল্প সময় ট্রেনিং দিয়ে নামিয়েছে’।
মিয়ানমারের অনেক রোহিঙ্গা এখন মিয়ানমার আর্মির পক্ষে থেকে আরাকান আর্মির বিপরীতে লড়ছে। আরাকান আর্মি হচ্ছে জাতিগত রাখাইনদের একটি বিদ্রোহী সংগঠন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চলতি বছরের অগাস্ট মাসে এক প্রতিবেদনে বলেছে, আরাকান আর্মিকে ঠেকানোর জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের নিয়োগ করেছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মিয়ানমার বাহিনীর সাথে একত্রিত হয়ে জাতিগত রাখাইনদের ওপর হামলা করেছে বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়। এর ফলে আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের ওপর পাল্টা হামলা চালায়।
মংডুর রোহিঙ্গারা কেন মিয়ানমার বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে?
‘হতে পারে এটি বাধ্য হয়ে। অথবা কোনো প্রলোভনে। কিন্তু যে কারণেই হোক, ওখানকার রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মির ওপর চড়াও হয়েছে,’ বলেন এমদাদুল ইসলাম।
এদিকে বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
‘এখন…ওইদিকের রোহিঙ্গাদেরকে নিয়ে মিয়ানমার আর্মি যদি আরাকান আর্মির সাথে সঙ্ঘাতটা বাঁধাতে পারে, তাহলে তার প্রভাব আমাদের এখানকার রোহিঙ্গাদের ওপরও পড়বে,’ বলছিলেন তিনি।
‘কারণ তারা দেখবে যে তাদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী মারামারিতে লিপ্ত হয়ে গেছে। তখন তারা ভাববে যে রোহিঙ্গাদের মারছে। আর, রোহিঙ্গারা সফল হলে তারাও ওখানে যোগ দিতে চাইবে,’ বলেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি