পাহাড়ি খাদ্যসংস্কৃতিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
- মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম (বান্দরবান)
- ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪২
তিন পার্বত্য জেলার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির মাঝে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের খাদ্যসংস্কৃতিতে বিদ্যমান এক বিশেষ মাত্রা। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা সহজলভ্য উপাদানের সৃজনশীল ব্যবহারই যেন পাহাড়ি খাবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ জনপদের একাধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর খাবারে প্রতি পদে মিশে থাকে চিরায়ত ঐতিহ্য। এ যেন পাহাড়ি প্রকৃতির সুবাস আর নদী-বন-ঝরনার নির্মল সজীবতা! প্রকৃতির উপাদানে তৈরি এসব খাবার একদিকে যেমন সুস্বাদু, অন্যদিকে তেমনি পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর।
জানা যায়, পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও সংগৃহীত শাকসবজি, ফল, মাছ, গোশতসহ বিভিন্ন ধরনের পাহাড়ি লতাগুল্ম-মশলা দিয়ে তাদের নিত্যকার খাবার তৈরি করেন। তিন জেলার শহুরে জনপদের চেয়ে দুর্গম পাহাড়ি বাসিন্দাদের খাদ্যসংস্কৃতি এখনো বুনো জীবন-যাপনের সাথেই সম্পৃক্ত। বর্ষা মৌসুমে সদ্যউত্থিত কচি বাঁশ এনে দিয়েছে পাহাড়ি খাবারে বিশেষ স্বাদ ও স্বাতন্ত্রতা, যা স্থানীয় ভাষায় বাঁশ কোড়ল নামে পরিচিত।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাবারের বিবরণ নিচে দেয়া হলো।
বাঁশ কোড়ল
‘বাঁশ কোড়ল’ অন্যতম জনপ্রিয় একটি পাহাড়ি সুস্বাদু খাবার। এটি পার্বত্য বাঙ্গালীদের কাছে ‘বাশঁ কোড়ল’ নামে পরিচিত হলেও এটি মুরুং বা ম্রোরা ‘রায়’, মারমারা ‘মহ্ই’, চাকমারা ‘বাচ্ছুরি’, এবং ত্রিপুরারা ‘মেওয়া’ নামেই পরিচিত। বর্ষাকালে বাজারে এ সবজির প্রচুর যোগান বিদ্যমান। মাছ, গোশতের সাথে কিংবা ভাজি-ভর্তা হিসেবে বাঁশ কুড়লের ব্যবহার পাহাড়ি খাদ্যসংস্কৃতিকে করেছে প্রাণবন্ত।
এছাড়াও বাঁশ কোড়ল ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমান সময়ে বাহারি আইটেমের চমকপ্রদ সব রেসিপিও তৈরী হচ্ছে। এতে রয়েছে আদিমতার স্বাদ ও অপরিমেয় পুষ্টি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠির পাশাপাশি বাঙ্গালিদের কাছেও এটি একটি জনপ্রিয় খাবার। পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিংগ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাইজ্যা বাঁশ ও কালিছুরি জাতের বাঁশঝাড় থেকে মাটি ভেদ করে উত্থিত ডগা পাঁচ-ছয় ইঞ্চি গজিয়ে উঠলে এটি খাওয়ার উপযোগী হয়। জাতের ভিন্নতার সাথে বাঁশ কোড়লের স্বাদেও ভিন্নতা রয়েছে। জানা গেছে, বাঁশ কোড়লে পানি, প্রোটিন, চর্বি, চিনি, সেলুলোজ ও খনিজ পদার্থের উপাদান রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়।
আলীকদম ম্রো কল্যাণ ছাত্রাবাসের পরিচালক ইয়োংলক ম্রো জানান, ‘মুলি বাঁশের রায় (কোড়ল) সবচেয়ে সুস্বাদু। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়িদের প্রিয় সবজি। এটি বিক্রি করে পাহাড়িরা জীবিকাও নির্বাহ করে।’
নাপ্পি বা সিদল
পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর খাদ্যসংস্কৃতির আরেকটি বিশেষ উপাদান নাপ্পি বা সিদল। তীব্র গন্ধযুক্ত হলেও পাহাড়িদের যেকোনো রান্নায় বাড়তি স্বাদ এনে দিতে যেন নাপ্পির জুড়ি নেই! কলাপাতায় মুড়িয়ে, সামান্য পুড়িয়ে কিংবা পানিতে গুলিয়ে অথবা সরাসরি তরকারির সাথে নাপ্পির ব্যবহার হয়।
আলীকদমের তরুণ সংবাদকর্মী সুহৃদয় তঞ্চঙ্গ্যা জানান, পাহাড়িদের রান্নায় নাপ্পি অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান। এটি তরকারি ও ভাজি-ভর্তার স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। শুটকি মাছের মতো সব তরকারিতেই নাপ্পি ব্যবহার করা হয়। পাহাড়ি সব জনগোষ্ঠীর কাছে এটি জনপ্রিয় খাবার। বিশেষ করে মরিচ ভর্তার সাথে নাপ্পির মিশ্রণে সুস্বাধু রঞ্জন তৈরি হয়।
পাহাড়ের ‘নাপ্পি’ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দাদের কাছে একটি মুখরোচক খাবার, যা ‘সিদল’ নামে পরিচিত। সমতলে মলা, পুঁটি, টাকি মাছের শুটকির সাথে কচু বা মানকচুর ডাটা দিয়ে সিদল তৈরি হয়।
অপরদিকে, পাহাড়িদের নাপ্পি তৈরি হয় মিম চিংড়ি হিসেবে পরিচিত শুকনো চিংড়ি গুড়ো করে সাথে লবণ ও পানির মিশ্রণে। নাপ্পি সাধারণত কক্সবাজারের চৌফলদণ্ডী, খুরুশকুল, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফসহ উপকূলীয় এলাকার রাখাইনপল্লিতে গ্রীষ্মমৌসুমে তৈরি হয়। পাহাড়িদের এ খাদ্য উপাদান উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম।
মুন্ডি
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মারমা সম্প্রদায়ের অন্যতম একটি প্রিয় খাবারের নাম ‘মুন্ডি’। এটি একপ্রকার স্থানীয় নুড়ুলস, যা চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয়। মুন্ডি মারমা ভাষার একটি শব্দ। বিশেষ করে বান্দরবানের যেকোনো পাহাড়ি এলাকায় খাবারের দোকানে মুন্ডি পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এটি একটি জনপ্রিয় খাবার হিসেবে পরিচিত হচ্ছে।
আলীকদম উপজেলা সদরের দ্যা দামতুয়া ইন অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক অংশেথোয়াই মারমা জানান, মুন্ডি মারমাদের পাশাপাশি অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙ্গালীদের কাছেও ঐতিহ্যের ধারা বহন করে চলেছে।
তিনি জানান, ইদানীং অনেক পর্যটকদের কাছেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে মুন্ডি। এটি সুস্বাদু ও জনপ্রিয় খাবার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। টক-ঝালের মিশ্রণে বিভিন্ন মশলার সংযোগে ডিমের সাথে এটি পরিবেশন করা হয়। টক-ঝালের মিশ্রণ ও পরিমাণ নিজের মতো করে বাড়িয়ে কমিয়ে নেয়া যায়।
জানা যায়, পাইজাম, মিনিকেট কিংবা উন্নতজাতের চাল এক সপ্তাহ থেকে ১৫ দিনের মতো পরিস্কার পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর চালে গরম পানি দিয়ে ছোট সাইজে দলা পাকানো হয়। পরে একটি বিশেষ মেশিনে তৈরি করা হয় মুন্ডির নুডলস। তবে ইদানীং প্যাকেটজাত মুন্ডি পাওয়া যায়।
ব্যাম্বু চিকেন ও বাঁশ বিরিয়ানী
সাধারণত বাঁশের কঞ্চির মধ্যে মুরগির গোশত রান্না ‘ব্যাম্বু চিকেন’ হিসেবে পরিচিত। ছোট সাইজের মুরগির গোশত সাথে প্রয়োজনীয় মশলা মিশিয়ে বাঁশের কঞ্চিতে ভরে আগুনে পুড়িয়ে এটি রান্না করা হয়। আগুনে পুড়িয়ে রান্না হয় বলে কাঁচা বাঁশের একধরনের প্রাকৃতিক সুগ্রাণ যুক্ত হয় খাবারে, যা খাবারে অপূর্ব রসনা-ব্যঞ্জন সৃষ্টি করে। পাহাড়িদের সাথে সাথে ভোজন বিলাসীদের কাছেও খাবারে এ যেন এক নতুনমাত্রা!
অপরদিকে, প্রথমে গোশতের টুকরো প্রয়োজনীয় মশলার সংমিশ্রণে সামান্য তেল মাখিয়ে কষিয়ে নিতে হয়। এরপর কষানো গোশতের সাথে ভিজিয়ে রাখা চাল মিশিয়ে কাঁচা বাঁশের খোলে ঢুকিয়ে কলাপাতার সাহায্যে মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে ১৫-২০ মিনিটের মতো আগুনে ঝলসিয়ে নিলে কাঁচা বাঁশ থেকে বের হওয়া ঘামে এই বিরিয়ানি রান্না হয়ে যায়। এভাবেই তৈরি হয় অসাধারণ বাঁশ বিরিয়ানী!
পাজন
পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী আরেকটি পরিচিত খাবার ‘পাজন’। পাজন একটি নিরামিষ খাবার। এটি পাহাড়ি শাকসবজিসহ, বাঁধাকপি, মিষ্টি কুমড়ো, বরবটি, পুঁইশাক, মুলা ইত্যাদির সংমিশ্রণে তৈরি হয়। সবজির সাথে কাঁচা মরিচ, আদা, রসুন, লবন ইত্যাদি মিশিয়ে একসাথে পানিতে সিদ্ধ করা হয়।
পাজন একটি চাকমা ভাষার শব্দ। পাজনকে মারমারা হাং-র, ত্রিপুরারা মৈজারবং, চাক সম্প্রদায় কাইনবোং বলে থাকে। পাহাড়ে বর্ষ বিদায় ও বরণের সময় পাজন রান্না করা উৎসবের অংশ। পাহাড়িদের কাছে পাজন রান্নার ঐতিহ্য কয়েক শ’ বছরের।
আলীকদমে কর্মরত একটি এনজিও’র মাঠ কর্মকর্তা জেসমিন চাকমা জানান, ‘সাধারণত পাহাড়ের বিজু, বৈসুক, সাংগ্রাই, বিষু, সাংক্রান উৎসবে পাজন রান্না হয়। আমাদের বিশ্বাস, পাজন খেলে সুস্থ ও রোগ-ব্যাধি মুক্ত থাকা যায়। বহুপদের সবজির মিশ্রণ থাকে বলে এটি রোগ-বালাইয়ের মহৌষধ। তাই সুস্থ থাকার জন্য পাজন খাওয়া আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতির একটি অংশ।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা