ছেলের রক্তমাখা গেঞ্জি বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন মা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:১০, আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:২৩
আমার ছেলে সাদমান কুমিল্লা সিসিএন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে ঢাকায় ইন্টার্ন করতে যায়। ইন্টার্ন শেষে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাবাকে আর বিদেশ থাকতে দেবে না। সংসারের জন্য আয় রোজগার করবে। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পদত্যাগের পর বিজয় মিছিলে যায় সাদমান। অনেক আনন্দ করে, আনন্দের সময় আমাকে ফোনও দিয়েছিল। ছেলেটার সে আনন্দকে শেষ আনন্দ করে দিলো শেখ হাসিনার স্বৈরাচার বাহিনী। নির্মমভাবে গুলি করে মারল তাকে।
কথাগুলো বলতে বলতে ছেলের রক্তমাখা গেঞ্জি বুকে নিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন শহীদ হামিদুর রহমান সাদমানের (২২) মা কাজি শারমিন আক্তার (৩৭)।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের পরনের রক্তমাখা এ জামাটি আমার কাছে এখন অমূল্য সম্পদ। এ জামায় আমি ছেলের শরীরের গন্ধ পাই।’
হামিদুর রহমান সাদমান গত ৫ আগস্ট কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাকার বংশালে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
সাদমান নগরীর দেশওয়ালিপট্টি এলাকায় থাকতেন। গ্রামের বাড়ি সদর দক্ষিণ উপজেলার চৌয়রা ইউনিয়নের দিঘলগাঁও মজুমদার বাড়ি। বাবা ইকবাল মজুমদার (৫৫) বাহরাইন প্রবাসী।
পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, সাদমান কুমিল্লা সিসিএন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে ঢাকায় ইন্টার্ন করতে যান। গত ৫ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল ছিল ঢাকা। একপর্যায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বিকেলে সাদমান বাসা থেকে বের হন বিজয় মিছিলে যোগ দিতে। সে সময় বংশাল থানার সামনে বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। এ সময় সাদমানের বুকে গুলি লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই মারা যান তিনি। পরদিন তার লাশ কুমিল্লায় নেয়া হয়। নগরীর দেশওয়ালিপট্টির মুন্সেফবাড়িতে প্রথম জানাজা এবং গ্রামের বাড়ি সদর দক্ষিণ উপজেলার চৌয়রা ইউনিয়নের দিঘলগাঁও মজুমদার বাড়িতে দ্বিতীয় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
শহীদ সাদমান তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। ২০০৫ সালে তার ছোট ভাই পানিতে ডুবে মারা যায়। সাদমান আদর্শ সদর উপজেলার সাতরা চম্পকনগর সরকারি প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণী ও কুমিল্লা মর্ডান হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে কুমিল্লা সিসিএন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে চার বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্স শেষে করে ঢাকায় ইন্টার্নশিপ করতে যান।
সাদমানের চাচী ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের একান্নবর্তী পরিবার হওয়ায় সবার মধ্যমণি ছিল সে। সবসময় সবার কাজে এগিয়ে যেত। পারিবারিক, সামাজিক সকল কাজে সবার আগে এগিয়ে যেত, দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখত। আমি মনে করি তার দায়িত্বশীল আচরণের কারণে সে ঘরে বসে থাকতে পারেনি। দেশ গঠনে সে এগিয়ে গিয়েছিল। দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য সে শহীদ হয়েছে।’
তার চাচা এনায়েত করিম মজুমদার জানান, আমার ভাতিজা নিহত হওয়ার ঘটনায় আমরা শোকাহত। কিন্তু গর্বিত সে শহীদ হয়েছে। একটি জালিম ও স্বৈরশাসককে বিতাড়িত করতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সে অংশ নিয়েছে। দেশের পরিবর্তন করেছে। সেজন্য আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। তবে আমার ভাতিজার মত আরো অনেকেই শহীদ হয়েছেন। অনেক বাবা-মায়ের বুক খালি হয়েছে। আমরা এসব হত্যার বিচার চাই।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব চৌধুরী বলেন, দেশের অনেক ছাত্র ভাইয়েরা দেশ রক্ষায় আত্মাহুতি দিয়েছে। এ উপজেলায়ও দু’জন সূর্য সন্তান রয়েছে, তার মধ্যে একজন সাদমান। তাকেও রাষ্ট্রিয়ভাবে শহীদি মর্যাদাসহ পরিবারকে সকল সুযোগ সুবিধা দেয়ার অনুরোধ করছি। সাথে সাথে তাদের স্মৃতি রক্ষায় সড়কের নামকরণসহ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জোর দাবি জানাচ্ছি।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবাইয়া খানম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এ উপজেলায় দু’জন শহীদ হয়েছে। এর মধ্যে মাছুম মিয়া নামে একজন কুমিল্লায় ও অপরজন হামিদুর রহমান সাদমান ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এরইমধ্যে আমিসহ জেলা প্রশাসক মো: আমিরুল কায়ছার, পুলিশ সুপার মো: আসফিকুজ্জামান আকতারসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ দু’জন শহীদের বাড়িতে গিয়েছি। পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নিয়েছি এবং এখনো রাখছি। তাদের বিষয়ে সরকার থেকে আমাদের যে নির্দেশনা দেবে, আমরা সেগুলো বাস্তাবায়ন করব।
সূত্র : বাসস
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা