২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
লোকসানের মুখে পর্যটন শিল্পে বিপর্যয়

বান্দরবানের পর্যটন শিল্প আবারো ঘুরে দাঁড়াবে, প্রত্যাশায় ব্যবসায়ীরা

- ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রায় নয় লক্ষ টাকা সালামি ও মাসে ২০ হাজার টাকা চুক্তিতে বান্দরবান শহরের কাছে লালমোহন বাহাদুর বাগান এলাকায় স্বপ্ন বিলাস নামে ছোট একটি রিসোর্টের ব্যবসা শুরু করেন সোহেল কান্তিনাথ নামের এক তরুণ উদ্যোক্তা।

গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে বান্দরবানের সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে পর্যটকদের ভ্রমণে প্রশাসনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ও সাম্প্রতিক দেশের সংঘাতময়ী পরিস্থিতির কারণে পর্যটন ব্যবসায় লোকসান শুরু হলে চিন্তায় পড়ে যান ব্যবসায়ী সোহেল। রিসোর্ট থেকে লাভ তো দূরের কথা ভাড়ার টাকা উঠাতে তার হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সোহেলের মতো এমন অনেক রিসোটের মালিকের এখন একই অবস্থা। ইতোমধ্যে অনেক হোটেল রিসোর্ট লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, ছাঁটাই করা হয়েছে অর্ধেকেরও বেশি কর্মচারী। নতুন করে কোনো রিসোর্টই আর এখন দাঁড়াতে পারছে না। জেলার সেনাবাহিনী পরিচালিত নীলগিরি রিসোর্ট ছাড়া অন্য সব রিসোর্ট এখন লোকসানের মুখে।

পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, জেলার হোটেল মোটেল রিসোর্ট, পর্যটন পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ি, ট্যুর গাইড, নৌ-পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে প্রায় পাঁচ হাজার লোক জড়িত রয়েছে। পর্যটন খাতকে ঘিরে নতুন একটি কর্মসংস্থানের তৈরি হয়েছে।

প্রকৃতির অপার সুন্দর পার্বত্য জেলা বান্দরবানে গত এক যুগে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বান্দরবানের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প। কক্সবাজারের কাছাকাছি হওয়ায় পাহাড় আর প্রকৃতি দেখতে পর্যটকটা ছুটে আসে বান্দরবানে। সাধারণ যেসব পর্যটন কেন্দ্রগুলো রয়েছে তার বাহিরে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর, ট্রেকিং, মাউন্টেন সাইক্লিং-সহ এসব বিষয় প্রচুর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বান্দরবানে। বিশেষ করে দুর্গম এলাকার পাহাড়ি ঝরনা নদী পাহাড়ি গ্রাম ও পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি দেখতে লক্ষাধিক পর্যটক ছুটে আসতো এই জেলায়।

প্রশাসনের হিসেবে প্রায় দেড় শতাধিক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে বান্দরবানে। সেইসাথে আরো নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র খুঁজে বের করছিল অ্যাডভেঞ্চার প্রেমিক পর্যটকরা। তবে গত দু’বছর ধরে পাহাড়ের নতুন গজিয়ে ওঠা সশস্ত্র সংগঠন কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট কেএনএফের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও তাদের দমনে অভিযানের কারণে কয়েকটি উপজেলায় পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার কারণে পুরো পর্যটন ব্যবসায় এখন ধ্স নেমেছে। এরই মধ্যে সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী আন্দোলনের কারণে দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মরার ওপর খরার ঘা নেমে আসে পর্যটন শিল্পে। সব দিক মিলিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবনধারা।

জেলার হোটেল মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, বান্দরবান শহরের যেসব আবাসিক হোটেল রয়েছে তাতে পাঁচ শ’-এরও বেশি পর্যটক থাকতে পারে। সেইসাথে আরো শতাধিক ছোট বড় পর্যটন রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক অস্থিরতায় পুরো পর্যটন শিল্প এখন লোকসানে পড়েছে। করোনাকালীন সময়ে যে ক্ষতি হয়েছিল পর্যটন শিল্পে সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই সন্ত্রাসী তৎপরতায় গত দু‘বছরের বেশি সময় ধরে পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমে এসেছে।

ক্ষুদ্র পর্যটন উদ্যোক্তা মোহাম্মদ সাইদুল প্রায় সাড়ে নয় লাখ টাকা বছরে নীলাচল পর্যটনকেন্দ্রে প্রশাসন থেকে ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। নীলাম্বরী রিসোর্ট তৈরি করে সেখানে গত দু’বছর ধরে তিনি লোকসান গুনছেন। একই অবস্থা চিম্বুক পাহাড়ের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্র ও রিসোর্টগুলোতে।

চিম্বুক পাহাড়ের ওয়াই জংশন এলাকার সাইরু রিসোর্ট কোনোভাবে চললেও অন্যান্য ছোটখাটো রিসোর্টগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনাকালীন সময়ে সরকারের কাছে প্রণোদনা চেয়েছিলেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। পর্যটনের ব্যবসার সাথে জড়িত পরিবহন শ্রমিকদের মাঝে কিছু সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হলেও ব্যবসায়ীরা ক্ষতি এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি।

শহরের কাছে পর্যটন মোটেলের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ সোয়েব জানান, বর্তমানে পর্যটক শূন্য থাকায় প্রতি মাসে পর্যটন শিল্পে বান্দরবানে কয়েক কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর পুরো প্রভাব পড়েছে পর্যটন শিল্পে। শুধু পর্যটন মোটেলেই গত দুই মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বান্দরবানের পর্যটন শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। অনেকে বাধ্য হবে হোটেল-মোটেল রিসোর্ট বন্ধ করে দিতে। লোকসানের কারণে কর্মচারী ছাঁটাইও চলছে।

পর্যটন শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে যেসব পরামর্শের কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা :
বান্দরবানে সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন রোয়াংছড়ির দেবতা খুম পর্যটনকেন্দ্রে। খুব কাছের পর্যটন কেন্দ্র হওয়ায় পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এখানে ঘুরতে। তবে সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে এই পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকরা যেতে পারছেন না। তবে ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা বলছেন, রাঙ্গামাটির সাজেকের মতো নিরাপত্তা বাহিনীর পাহাড়ায় পর্যটকদের এই পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এতে করে পর্যটন ব্যবসা যেমন ঘুরে দাঁড়াবে তেমনি পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে নিরাপত্তা বোধ করবে।

অন্যদিকে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সরকারকে পর্যটন ব্যবসায় প্রণোদনের ব্যবস্থা করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এছাড়া পর্যটকদের ভ্রমনের যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা কিছু পর্যটন কেন্দ্রের বিবেচনায় শিথিল করা গেলে পর্যটকদের আগমন বাড়বে বান্দরবানে।

প্রশাসন যা বলছে :
জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, পর্যটন শিল্পের লোকসানের কারণে পর্যটক ব্যবসায়ীরা এখন উদ্বিগ্ন। পর্যটন শিল্পকে আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে বেশ কিছু পরিকল্পনা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, সরকার এ বিষয়ে খুব দ্রুত উদ্যোগ নিবে। সেইসাথে এখন যেসব পর্যটক বান্দরবানে ভ্রমনে আসছে তাদের নিরাপত্তায় ও সার্বিক সহযোগিতায় প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement