২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দুই দিন পরেও থমথমে খাগড়াছড়ি

খাগড়াছড়িতে শনিবার দুপুরে অবরোধের চিত্র - ছবি : বিবিসি

বিক্ষোভ মিছিলে সংঘর্ষ, বাজারে আগুনে শতাধিক দোকানঘর পুড়ে যাওয়ার দুইদিন পরেও থমথমে হয়ে রয়েছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা বাজার।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা বাজারে কবির হোসেনের ছোট দোকানটি বৃহস্পতিবারের পুড়েছে সহিংসতার আগুনে।

শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সেই পুড়ে যাওয়া দোকান থেকে কিছু মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন হোসেন। কিন্তু সেখানে থেকে তেমন কিছু বাঁচাতে পারেনি। এই আগুনে পুড়েছে কয়েক লাখ টাকার মালামাল।

শনিবার দুপুরের পর দীঘিনালা বাজারের সেই ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর দেখা যায় সেখানে এখনো থেমে থেমে ধোয়া উড়ছে। এরই মাঝখানে অনেকেই পুড়ে যাওয়া দোকান থেকে তাদের মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।

তবে শুধু বাঙালিদের দোকান নয়, পুড়েছে পাহাড়িদের দোকানঘরও।

সুইটি দেওয়ান নামে এক নারী বিবিসি বাংলার কাছে অভিযোগ করেন, বাজারে তাদেরও দোকান ছিল। সেটিও পুড়েছে আগুনে। একইসাথে বাজারের পাশে থাকা তাদের বাড়িতেও হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে।

এখনো দীঘিনালায় থমথমে পরিবেশ রয়েছে।

এমনকি শনিবার বিকেলে যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সেখানে এসে বক্তব্য শুরু করেন, তখনো সেখানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তৈরি হয়।

দীঘিনালার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার থেকে তিনদিনের অবরোধ চলছে তিন পার্বত্য জেলায়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দীঘিনালাসহ পুরো খাগড়াছড়ি জেলায় চলছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল।

বৃহস্পতিবারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় এখনো বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা দেখা গেছে।

এখনো স্বাভাবিক হয়নি দীঘিনালার পরিস্থিতি
শনিবার দুপুরের পর দীঘিনালা বাজারে গিয়ে লারমা স্কয়ারের দোকানগুলো থেকে এখনো ধোয়া উড়তে দেখা যায়।

এরই মাঝখানে অনেকেই নিজ দোকানের মালামাল অবশিষ্ট আছে কী না তা খুঁজে ফিরছিলেন।

কেউ কেউ আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বাঁশ কিংবা খুঁটি দিয়ে মেরামতের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও ক্ষতিগ্রস্ত লারমা স্কয়ারের দোকানদারদের দাবি, বৃহস্পতিবার বিকেলে ঘটে যাওয়া এই আগুনে অন্তত ১০০’র ওপরে দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

এই বাজারে আগুনের ঘটনায় পাহাড়ি ও বাঙালি দুই জনগোষ্ঠীর মানুষেরই দোকান পুড়েছে।

দীঘিনালার লারমা স্কয়ার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি নিপন চাকমা বলেন, ‘এই দোকান করে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করত। পুড়ে যাওয়ার পর অনেক বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে সবার’।

এই ঘটনার পর এটিতে যতটা না আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে দাঙ্গার শঙ্কার কথা বলছিলেন দীঘিনালা বাজারে থাকা বাঙালী জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ।

দীঘিনালা থানার ওসি নুরুল হক বলেন, ‘এই ঘটনায় আমরা প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। সবার সাথে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছি। তবে এখনো অনেকের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ আছে’।

বাজার আগুন লাগিয়েছে কারা?
বুধবার দীঘিনালা উপজেলায় মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় মো: মামুন নামের এক যুবক গণপিটুনির শিকার হন। পরে সে মারাও যান।

এই ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর দীঘিনালা কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি যখন দীঘিনালার লারমা স্কয়ার পর্যন্ত এগিয়ে গেলে মিছিলের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

শনিবার বিকেলে দীঘিনালা বাজারে কথা হয় শিক্ষার্থী তাইফুল ইসলামের সাথে।

ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা মিছিল নিয়ে চলে যাওয়ার পর পেছন থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ করে পাহাড়ি সংগঠনের কয়েকজন। পরে তারা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালায়। পরে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়’।

দীঘিনালায় জনবসতির দিক থেকে বাঙ্গালি ও পাহাড়িদের অনুপাত প্রায় সমান। মূলত ওই মিছিলে হামলার ঘটনার জের ধরে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠী দুই ভাগে ভাগ হয়ে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে।

স্থানীয় বোয়ালখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চয়ন বিকাশ চাকমা বলেন, ‘এই হামলার সময় বাজারে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আমরা জানি না। আমরা কাউকে আগুন ধরিয়ে দিতে দেখিনি।’

তবে স্থানীয় কয়েকজন পাহাড়ি বাসিন্দা দাবি করেন, সন্ধ্যার কিছু আগে স্থানীয় মসজিদে মাইকিং হয়েছিলো। পরে সেখান থেকেই উত্তেজনা ছড়ায়। পরে হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটে।

তবে, এই বাজারে এ নিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর কেউ ক্যামেরা বা প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি।

তবে কয়েকজন দাবি করেন, বাঙালিদের পক্ষ থেকে বা মিছিল থেকে বাজারে আগুন লাগানো হয়নি। বরং তাদের অভিযোগ পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে।

ওই ঘটনার বিষয়ে শুক্রবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মোটরসাইকেল চুরি নিয়ে বুধবার একজন বাঙালি যুবকের মৃত্যু হলে দীঘিনালা কলেজ থেকে বৃহস্পতিবার একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর দাবি করেছে, ‘মিছিলটি দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় ইউপিডিএফের (মূল) কতিপয় সন্ত্রাসী মিছিলের ওপর হামলা করে ও ২০-৩০ রাউন্ড গুলি ছড়ে। এ প্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বোয়ালখালী বাজারের কয়েকটি দোকানে অগ্নি সংযোগ করে।’

তবে এ বিষয়ে ইউপিডিএফের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

উপদেষ্টার সামনেই হট্টগোল-বিশৃঙ্খলা
শনিবার বিকেলের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম আসেন দীঘিনালা বাজারে। সেখানে তিনি লারমা স্কয়ারের ক্ষতিগ্রস্ত দোকান পরিদর্শন করেন।

এরপর বাজারে স্থানীয় প্রশাসনকে সাথে নিয়ে বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বলেন। সেখানে পাহাড়িদের পক্ষ থেকে বোয়ালখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান চয়ন বিকাশ চাকমা বক্তব্য দিতে শুরু করলে হঠাৎ হট্টগোল তৈরি হয়।

এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হট্টগোল চলে। পরে বক্তৃতা থামিয়ে দেন চেয়ারম্যান চয়ন বিকাশ চাকমা।

পরে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বক্তব্য শুরু করলে স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর অনেকেই এই ঘটনায় পাহাড়িদের দায়ী করে শ্লোগান দিতে থাকেন।

পরে তাদের সাথে কথা বলে থামান ইসলাম।

পরে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘শুধু এই পার্বত্য এলাকায় না, সারাদেশে একই সময় বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে কোনো পক্ষের ইন্ধন আছে কী-না তা খতিয়ে দেখবে সরকার।’

এ সময় তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা সবাই ক্ষতিপূরণ পাবে। একইসাথে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার বিচার করা হবে।’

পরে সেখান থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে স্থানীয়দের সাথে নিয়ে বৈঠক করেন তথ্য উপদেষ্টা।

চলছে অবরোধ, স্বাভাবিক ইন্টারনেট
ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার রাত থেকে পুরো উপজেলার প্রতিটি পয়েন্টে চলছে সেনাবাহিনীর টহল। চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।

তবে, দীঘিনালা বাজারে আগুন ও সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনার শনিবার থেকে পাহাড়িদের বাসিন্দাদের ডাকা তিনদিনের অবরোধ চলছে।

অবরোধের কারণে রাস্তায় যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল।

দীঘিনালা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নুরুল হক বলেন, ‘এখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা। সেই কাজ আমরা করে যাচ্ছি।’

বৃহস্পতিবার আগুনের ঘটনার পর দীঘিনালার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবরো প্রকাশ পায়। যা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টে কেউ কেউ দাবি করেছেন, সরকার থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ নাকচ করে দেয়া হয়েছে।

এ নিয়ে সেখানে পরিদর্শনে যাওয়ার পর তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এই এলাকায় কোনো ইন্টারনেট সেটা বন্ধ করার মতো কোনো চিন্তাও আমরা করি না। এটি নিয়ে যে ধরনের গুজব হচ্ছে সেটি যারা করছেন তাদের উদ্দেশ্য কি সেটি আমরা জানতে চাই’।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement