০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ৮ রজব ১৪৪৬
`

দেড় দশকে কমিশন বাণিজ্যে শেয়ারবাজারে এসেছে অর্ধশতাধিক দুর্বল কোম্পানি

পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা
দেড় দশকে কমিশন বাণিজ্যে শেয়ারবাজারে এসেছে অর্ধশতাধিক দুর্বল কোম্পানি -


পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসনের দেড় দশকে পুঁজিবাজারে দুর্বল কোম্পানির আধিক্য বেড়ে গিয়েছিল। এসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে নানা অনিয়মের মাধ্যমে। সরকার সমর্থক এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী মিলে মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে এসব দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে সহায়তা করেছে। এর মধ্যমে পুঁজিবাজারের ওপর গ্রাহকের যেমন আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে, পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহক এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে হাজার হাজার কোটি টাকা খুইয়ে পথে বসেছে। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, এমন তালিকাভুক্ত দুর্বল কোম্পানির সংখ্যা অর্ধ শতাধিক ছিল। এর মধ্যে ২৮টি কোম্পানিই ইতোমধ্যে জেট শ্রেণিভুক্ত (অধিকতর দুর্বল) হয়েছে। এসব কোম্পানিতে সাধারণ গ্রাহকের কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে পড়ে গেছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে যেসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে এর অধিকাংশই দুর্বল কোম্পানি। অভিযোগ উঠেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেসব কোম্পানিকে শেয়ার মার্কেটে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, মূলত এখানে বড় অংকের কমিশনবাণিজ্য জড়িত। এতে এসব দুর্বল কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসার সুযোগ পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বল কোম্পানি বাজারে আসার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে বেশ কিছু কোম্পানি আবার প্রিমিয়াম হিসেবে টাকা নিয়েছে। এসব দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কিনে বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী পথে বসেছে। অনেক বিনিয়োগকারীর শেয়ারগুলো এখন কাগজে পরিণত হয়েছে। দুর্বল এসব কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। আবার যা দিচ্ছে তা নামেমাত্র। আবার অনেক কোম্পানি উৎপাদনের বাহিরে রয়েছে। সব মিলে দুর্বল কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে বিনোদকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দেড় দশকে তালিকাভুক্ত ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে জেট ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন লিমিটেড (এওএল), ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, বিচহ্যাচারি, দেশ গার্মেন্টস, এডভেন্ট ফার্মা, খুলনা পাওয়ার, প্যাসিফিক ডেনিমস, ফরচুন সুজ, এনার্জি পাওয়ার জেনারেশন, ভিএফএস থ্রেড ডায়িং, শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, এসকে ট্রিমস, লুবুরেফ বাংলাদেশ, লিবরা ইনফিউশন, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, ফনিক্স ফাইন্যান্স, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, ন্যাশনাল টিউবস, ন্যাশনাল ব্যাংক, মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজ, জিএসপি ফাইন্যান্স, ফার কেমিক্যাল, সেন্ট্রাল ফার্মা, বিডি থাই, বে লিজিং, এটলাস বাংলাদেশ, আনলিমা ইয়ার্ন ও ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্স।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্বল কোম্পানিগুলো শেয়ার মার্কেটে আনার মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্যের নামে বিপুল পরিমাণ এর অর্থ লেনদেন হয়েছে। এ জন্য খায়রুল কমিশন ও শিবলী কমিশনের সময় যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে দেখা যেতে পারে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তারা বলছেন তদন্তে দেখা যাবে এসব দুর্বল কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, গত দুই কমিশনের সময় সবচেয়ে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আসার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এসব কোম্পানির দুর্বল হলেও আবার অনেকেই প্রিমিয়াম গ্রহণ করেছে। এতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকারীকে পথে বসার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, দুর্বল কোম্পানিগুলোর কারণে শেয়ারবাজার এখন ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। বর্তমানে ৭৫ টাকার শেয়ার ২৫ টাকায় নেমেছে। অনেক বিনিয়োগকারী তাদের কষ্টার্জিত অর্থ এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে বিনিয়োগ করেছে। তারা এখন কিছুই পাচ্ছে না। তাদের শেয়ারগুলো কাগজে পরিণত হয়েছে। তালিকাভুক্ত দুর্বল কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না। কিছু কোম্পানি লভ্যাংশ দিচ্ছে নামেমাত্র। এসব দুর্বল কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে বাজারকে শেষ করে দেয়া হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে এসেছে তার অধিকাংশই দুর্বল কোম্পানি। আসলে এসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে এসেছে নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত হওয়ার জন্য। তালিকাভুক্তির পর নানা কারসাজিতে জড়িয়েছে। যে লক্ষ্য নিয়ে তারা শেয়ারবাজারে এসেছে সে অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এতে বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ বাজার বিমুখ হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন চৌধুরী বলেন, দেশের মুদ্রাবাজারে জবাবদিহি কম থাকায় অনেকেই অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন সুযোগ নিয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা অর্থের উৎস হিসেবে শেয়ারবাজারে না এসে মুদ্রা বাজারের দিকে যাচ্ছে। এতে দেশের শেয়ারবাজারে মূল ভিত্তি বা ভালো কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহ হারাচ্ছে। এমন সুযোগে দুর্বল কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এসব দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়ে শেয়ারবাজারের পরিবেশ নষ্ট করছে। ভালো কোম্পানি বা মূলভিত্তির কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন।

এ দিকে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা মেনে বেশ কিছু কোম্পানিকে জেড শ্রেণিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ডিএসই। এমন সিদ্ধান্তের কারণে যেসব কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার অধিকাংশই পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। নতুনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কারণে জেট শ্রেণিভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৪টি। এর আগে জেট শ্রেণিভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৫৬টি। বর্তমান পরিস্থিতিতে জেট শ্রেণিভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ২১ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে মোট তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের সংখ্যা ৩৯৭টি।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্বল কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে প্রায় ২১ ভাগ কোম্পানি জেড বা দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এমন ঘটনাকে বাজারের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন গত ১৫ বছরে আওয়ামী পতিত সরকারের সময় বিপুল সংখ্যক মানহীন কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়ার কারণে জেট ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কোনো বাছবিচার না করে অনেক কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করেছে যার ভুক্তভোগী সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এ বিষয়ে একটি ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিগত দুটি কমিশন নিজেদের ক্রেডিট নেয়ার জন্য মানহীন অনেক কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করেছে। এতে সময়ের সাথে সাথে এসব কোম্পানির আসল রূপ বের হয়ে আসছে। কিছু দিন যেতে না যেতেই এসব প্রতিষ্ঠান নামসর্বস্ব কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন আমাদের দেশে একবার তালিকাভুক্ত হওয়ার পর বাদ দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে বছরের পর বছর এসব দুর্বল কোম্পানি বাজার থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এটি যেকোনো দেশের শেয়ারবাজারের জন্য সার্বিকভাবে সুশাসনের পরিপন্থী বলে তিনি মনে করেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement