আস্থা ও পুঁজি হারানোর হাহাকার
বছর শেষে মূলধন কমেছে ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা- হামিদ সরকার
- ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
রাজনৈতিক অস্থিরতা আর বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রতি চরম আস্থাহীনতায় কেটেছে পুরো বছর। সঙ্কটে পুঁজি হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। উত্থানের চেয়ে পতনের পাল্লা বেশি থাকায় পুরো বছরে বাজারমূলধন কমেছে ১৫.১ শতাংশ বা এক লাখ ১৯ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। পুরো বছরে ডিএসইর প্রধান সূচকে কমেছে এক হাজার ২৬.৪৩ পয়েন্ট। আর চট্টগ্রাম স্টকের প্রধান সূচক সিএএসপিআইর সূচক এক বছরে চার হাজার ৩১.৭৯ পয়েন্ট হারিয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে পুঁজিবাজারে কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। পাশাপাশি নির্বাচনের পরে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে এমন আশাবাদও ছিল। ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকার পতন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিবর্তনেও পুঁজিবাজারের চেহারায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। পটপরিবর্তনের পর বাজার পরিস্থিতি উন্নতির যে প্রত্যাশার আলো বুকে ধারণ করেছিল তা তো হয়নি উল্টো আরো সঙ্কটের দিকে ধেয়েছে। ৯৫ শতাংশ বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান বর্তমানে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। আশা-নিরাশার দোলাচলে থেকেই শুরু হচ্ছে ২০২৫ সাল।
পুরো বছরের পুঁজিবাজারের লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৪ সালের শুরুতে বা পয়লা জানুয়ারি ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ২৪২.৮৭ পয়েন্টে। উত্থান-পতনের দোলাচলে এক বছরে সূচকটি এক হাজার ২৬.৪৩ পয়েন্ট হারিয়েছে। বর্তমানে ডিএসইর সূচকটির আকার পাঁচ হাজার ২১৬.৪৪ পয়েন্টে অবস্থান করছে। যার ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ডিএসই-৩০ সূচক ডিসেম্বর শেষে ১৫১.৮১ পয়েন্ট কমে এখন এক হাজার ৯৩৯.৭৩ পয়েন্ট অবস্থান করছে। যেখানে ২০২৪ সালের পয়লা জানুয়ারি সূচকটি ছিল ২ হাজার ৯১.৫৪ পয়েন্টে।
আর গত এক বছরে ১৫ দশমিক ১ শতাংশ বা এক লাখ ১৮ হাজার ২০৮ টাকা কমে ডিএসইর বাজারমূলধন ৬ লাখ ৬২ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সাত লাখ ৮০ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার বাজারমূলধন নিয়ে বছর শুরু করে ডিএসই।
২০২৩ সালে ডিএসইর দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৫৭৮ কোটি টাকা। এ বছর দৈনিক গড় লেনদেন দাঁড়িয়েছে ৬৬৩ কোটি টাকায়। এ সময়ে লেনদেন বেড়েছে ৯ শতাংশ। আরেক পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই এ বছর চার হাজার ৩১.৭৯ পয়েন্ট হারিয়েছে। বাজরমূধন কমেছে এই স্টকের আশি হাজার কোটি টাকা। সাত লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার বাজারমূলধন নিয়ে বছরটা শুরু করলেও শেষে এসে এখন ছয় লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে। বছরের শুরুতে লেনদেন হয় ৯ কোটি টাকার বেশি। আর বছরের শেষ দিন এসে সেটা ৪ কোটির বেশিতে দাঁড়ায়। শেয়ার হাতবদল বছরের প্রথম দিন ছিল ৩৫ লাখের বেশি, যা ডিসেম্বরের শেষ দিন অর্ধেকে বা ১৮ লাখে নেমেছে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৫ বছরে দেশের পুঁজিবাজারের পুঞ্জীভূত রিটার্ন হিসাব করলে দেখা যায় এটি ঋণাত্মক অবস্থায় আছে। ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর পরই দেড় বছর আগে নেয়া ফ্লোর প্রাইসের সিদ্ধান্ত তুলে নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ফলে দীর্ঘদিন আটকে থাকা শেয়ার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিক্রির প্রবণতা বেড়ে যায়। বিক্রির চাপে বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। এরপর বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
বাজারে আইপিও আসায় খরা
বিদায়ী ২০২৪ সালে আইপিও খরায় ছিল দেশের পুঁজিবাজার। ২০২৪ সালে মাত্র ৪টি কোম্পানির আইপিও আসে। তার আগের বছর ২০২৩ সালেও মাত্র চারটি কোম্পানির আইপিও আসে। পর পর দুই বছর এত কম আইপিও আসতে আর দেখা যায়নি। তবে এই আইপিওগুলোও মানসম্পন্ন নয় বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।
প্রায় এক লাখ বিও হিসাব বন্ধ
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পুঁজিবাজারে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়তে দেখা গেলেও তার আগে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকারী বাজার ছেড়েছেন। ২০২৪ সালের প্রথম দিন শেয়ারবাজারে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ৫৫১টি। আর ২০২৪ সালের শেষ কার্যদিবস শেষে বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৪৫১টি। অর্থাৎ এক বছরে বিও হিসাব কমেছে ৯১ হাজার ১০০টি বলে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সর্বশেষ তথ্য থেকে জানা গেছে।
বিদায়ী বছরের পুঁজিবাজার নিয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০২৪ সাল দেশের পুঁজিবাজারের জন্য একটি হতাশাজনক বছর ছিল। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ হলো বাজার দীর্ঘসময়ে আমাদের এখানে ফ্লোর প্রাইজ ছিল। এর কারণে বাজার সংশোধনের কোনো সুযোগ ছিল না। নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইজ ছিল। এটা উঠে যাওয়ার পর বেশ কিছু দিন পুঁজিবাজার সংশোধন হলো। তিনি বলেন, এরপর সরকার পরিবর্তনে বিনিয়োগকারীরা কিছুটা আস্থা ফিরে পেলো। তাও ছিল স্বল্প সময়ের জন্য। এরপর বিনিয়োগকারীরা বিও হিসাবে আস্থা হারানো শুরু করলো।
তিনি বলেন, এখানে ভলিয়ম মাত্রাতিরিক্ত কমেছে। লেনদেনের পরিমাণ কমতে কমতে এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে ৯৫ শতাংশ বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান বর্তমানে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। গত ১৫ বছরে দেশের পুঁজিবাজারের পুঞ্জীভূত রিটার্ন হিসাব করলে দেখা যায় এটি ঋণাত্মক অবস্থায় আছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে কোনো দেশের পুঁজিবাজার ঋণাত্মক অবস্থানে থাকার নজির নেই। বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে কোনো রিটার্ন পাচ্ছে না। বিনিয়োগ করার মতো পর্যন্ত স্টক নেই। ফলে বাজারের আস্থা তলানিতে। এই আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা না নেয়া হয়, আইনকানুন সংস্কার দিয়ে যথেষ্ট হবে না। কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগ সুরক্ষা পায়। তা না করলে ২০২৫ সালেও কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
২০২৪ সালের বাজার নিয়ে ডিএসইর পরিচালক মো: শাকিল রিজভী নয়া দিগন্তকে বলেন, খুবই খারাপ বছর গেছে। বিএসইসির চেয়ারম্যান অনেক অন্যান্য কাজ করেছেন। যার কারণে বাজার মন্দা ছিল। অনেক খারাপ শেয়ারও তার সময়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি পটপরিবর্তনে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবও একটা কারণ। তিনি বলেন, তবে বাজার খারাপ শুরু হয়েছে মূলত ২০২০ সালের করোনা পরিস্থিতি ও পরে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব। তবে এর মাঝেও পুঁজিবাজার একটু ভালো হয়েছিল। কিন্তু সেই ভালোটাও স্থিতিশীল বা টেকসই হয়নি।
শাকিল রিজভী বলেন, যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো যদি বাজারবান্ধব হয় এবং সংস্কারগুলো যদি যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যায় তা হলে আমরা আশা করছি আগামী বছর শেয়ারবাজার ভালো হবে। বাজারবান্ধব নীতি সংস্কারের পাশাপাশি বাজারে ভালো আইপিও আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। ভালো কোম্পানির আইপিও আনা সম্ভব হলে বাজারের গভীরতা বাড়বে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা