সাইবার নিরাপত্তা আইনের সব মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৭
আন্তর্জাতিক মানবধিকার সংগঠন ‘ক্লুনি ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিস’-এর ট্রায়ালওয়াচ ইনিশিয়েটিভ ও বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) যৌথভাবে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এবং আমেরিকান সময় সকালে শ্বেতপত্রটি এই দুই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত শ্বেতপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে বাতিল হওয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের অধীনে থাকা সব মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা উচিত।’ বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, যা দেশের কঠোর সাইবার আইনগুলোর পুনর্মূল্যায়নের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে তিনটি সাইবার আইনের আওতায় থাকা সব ‘মতপ্রকাশ সম্পর্কিত’ মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা যথার্থ দিকনির্দেশনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে বহুদিন ধরে এমন কিছু আইন প্রচলিত রয়েছে, যেগুলো ‘আপত্তিকর মন্তব্য’, ‘মিথ্যা তথ্য’, কিংবা এমন কোনো তথ্য যা ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘিœত করে’ বা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে’ ইত্যাদি সংবেদনশীল শব্দগুলোর অস্পষ্ট সংজ্ঞা দিয়ে আইনের মাধ্যমে মানুষের মত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। প্রকৃত অর্থে এসব আইনকে ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতকে দমন করা হয়েছিল এবং গণমাধ্যমকর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এসব আইন প্রথমে ২০০৬ সালের আইসিটি আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, পরে এটি ২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালের সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (সিএসএ)-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও প্রতিটি নতুন আইন প্রণয়নের সময় বলা হয়েছে এটি আগের তুলনায় সংস্কার করা হয়েছে, মূলত আইনগুলোর প্রায় সব ধারা বা নিষেধাজ্ঞা একই রকম রয়ে গেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে যে, সিএসএ (সর্বশেষ সংস্কার করা আইন) মূলত ডিএসএ-এর প্রায় সব কঠোর বিধানকেই নতুন করে যুক্ত করেছে, যার মধ্যে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও ৫৭ ধারা ও ডিএসএ বাতিল করা হয়েছে, তবুও সরকারি তথ্য অনুসারে, ডিএসএ ও আইসিটি আইনের অধীনে দায়ের করা এক হাজারেরও বেশি মতপ্রকাশ সম্পর্কিত মামলা এখনো চলছে। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ট্রায়ালওয়াচের পর্যবেক্ষণে থাকা একটি মামলাও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘হ্যাকিং, যৌন হয়রানি ও অন্যান্য গুরুতর সাইবার অপরাধের বিচার হওয়া গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা আইন অত্যন্ত অস্পষ্ট ও প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্যে বিরোধী মতকে দমন করার অনেক উপাদান রয়েছে। তাই আমরা এ আইনের অধীনে দায়েরকৃত সব মামলাকে বাতিল করার আহ্বান জানাই।’
এই যৌথ শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, আইনি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে এখন আইসিটি আইনের অধীনে থাকা সব মামলা বাতিল করা উচিত, কারণ এগুলোর আর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। সাধারণ আইন অনুসারে কোনো আইন বাতিল হলে তা কার্যত অতীত হয়ে যায়। তবে, ডিএসএ-তে একটি ‘সংরক্ষণ বিধান’ ছিল, যা সেই সময় আইসিটি আইনের অধীনে থাকা মামলাগুলোকে বাতিল না করে বহাল রেখেছিল। এরপর যখন ডিএসএ আইন বাতিল করে সিএসএ করা হলো, তখন ডিএসএ আইনের জন্যও একটি ‘সংরক্ষণ বিধান’ রাখা হলো, যা ডিএসএ আইন বাতিল হলেও সে আইনের অধীনে থাকা মামলাগুলোকে বহাল রেখেছে। কিন্তু ডিএসএ বাতিল হয়ে যাওয়ায় আইসিটি আইনের জন্য থাকা সংরক্ষণ বিধানটি স্বাভাবিকভাবেই আর কার্যকর থাকে না। সিএসএ-তে একই রকমের সংরক্ষণ বিধান থাকলেও এটি শুধু ডিএসএ-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং আইসিটি আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই, আইসিটি আইনের অধীনে থাকা মামলাগুলো এখনো বিদ্যমান থাকার আর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
ট্রায়ালওয়াচের বিশেষজ্ঞ ও ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট রেবেকা মামেন জন বলেন, ‘আইসিটি আইনের অধীনে থাকা মামলাগুলোর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। বাতিল হয়ে যাওয়া আইনের অধীনে থাকা পুরনো মামলাগুলোকে আবারো বহাল রাখা অনুচিত। বিশেষ করে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের মতপ্রকাশের অধিকারকে খর্ব করতে এ আইন ব্যবহার করা স্পষ্টতই আইনের অপব্যবহার।’
‘আপত্তিকর তথ্য’, ‘ভুয়া খবর’ ও ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘিœত হওয়ার সম্ভাবনা’ এ সম্পর্কিত অস্পষ্ট বিধান ও আইনগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আদালত ‘আপত্তিকর মন্তব্য’ ও ‘ভুয়া খবর’ সম্পর্কিত আইন বাতিল করছে, যার মধ্যে ভারত, উগান্ডা, কেনিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার আদালতও রয়েছে। জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলোও দীর্ঘদিন ধরে অস্পষ্ট ভাষায় প্রণীত এসব আইনের সমালোচনা করে আসছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ, যেখানে তারা দেশের আইন ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে। সুতরাং অবিলম্বে আইসিটি আইনের অধীনে থাকা সব মামলা বাতিল করা উচিত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা