দক্ষিণ এশিয়াতেও সন্তান না নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩৮
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জনসংখ্যা হ্রাস ক্রমান্বয়ে সঙ্কটে পরিণত হলেও এসব দেশের দম্পতিরা সন্তান না নেয়ার সিদ্ধান্তই বেছে নিচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে যেমন পাকিস্তান ও ভারত রয়েছে তেমনি বাংলাদেশ ও নেপালের মতো দেশও রয়েছে। আলজাজিরার এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে শুধু যে আর্থিক সঙ্গতির কারণে এসব দেশের দম্পতিরা সন্তান নিতে চাইছেন না তা নয়, প্রযুক্তি ও জলবায়ুর পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণও রয়েছে।
আলজাজিরার এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি জনসংখ্যাগত চ্যালেঞ্জ দক্ষিণ এশিয়ায় উঁকি দিচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য অংশের মতোই এ অঞ্চলে জন্মহার হ্রাস পাচ্ছে। ক্রমহ্রাসমান জন্মহার পশ্চিমা দেশগুলোর মতো জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সুদূর পূর্ব-এশীয় দেশগুলোতে দৃশ্যমান হয়েছে আগেই। এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেখানে জন্মহার সাধারণত উচ্চ থাকে, তারাও অবশেষে একই পথ অনুসরণ করার লক্ষণ দেখাচ্ছে।
কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আয়ো ওয়াহলবার্গ আলজাজিরাকে বলেছেন, সাধারণত, বর্তমান জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য, প্রতি মহিলার ২.১ শিশুর জন্মহার প্রয়োজন। ২০২৪ সালের ইউএস সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রকাশনা বিশ্বে নারীর সন্তান জন্মদানের হার তুলনা প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, ভারতে ১৯৫০ সালে জন্মহার ছিল ৬.২ যা বর্তমানে মাত্র ২ শতাংশের ওপরে। এটি ২০৫০ সালের মধ্যে ১.২৯ এবং ২১০০ সালের মধ্যে মাত্র ১.০৪-এ নেমে আসবে বলে অনুমান করা হয়েছে। নেপালে সন্তান জন্মদানের হার এখন মাত্র ১.৮৫; বাংলাদেশে নেমে দাঁড়িয়েছে ২.০৭ শতাংশে।
অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি : পাকিস্তানে জন্মহার আপাতত ৩.৩২-এ রয়েছে কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, সেখানকার তরুণরা আধুনিক জীবনের চাপ থেকে মুক্ত নয়। প্রতিবেদনটিতে পাকিস্তানের একজন নারী সাংবাদিক জুহা সিদ্দিকীর (ছদ্মনাম) উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে, সিদ্দিকী বলেন, ‘সন্তান না নেয়ার আমার সিদ্ধান্ত নিতান্তই আর্থিক। সিদ্দিকীর শৈশব ছিল আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায়। আমার বাবা-মা সত্যিই তাদের সন্তানদের জন্য কোনো আর্থিক পরিকল্পনা করেননি। সিদ্দিকীর অধিকাংশ বন্ধু এখন সন্তান না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তার বাবা-মা তাদের সন্তানদের ভালো স্কুলে পাঠালেও, স্নাতক বা স্নাতক শিক্ষার খরচ হিসাব করা হয়নি এবং পাকিস্তানে অভিভাবকদের জন্য কলেজ শিক্ষার জন্য তহবিল আলাদা করা সহজ কোনো বিষয় নয় বলে জানান সিদ্দিকী। তিনি মনে করেন না যে বর্তমান প্রজন্ম তাদের পিতামাতার প্রজন্মের মতো আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হবে।
কর্মজীবন ভারসাম্য : পাকিস্তান একা নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, চাকরির ঘাটতি এবং বৈদেশিক ঋণ মোকাবেলায় লড়াই করছে। এ দিকে বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার সঙ্কট অব্যাহত থাকায়, দম্পতিরা দেখতে পান যে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের জন্য বা সন্তানদের উৎসর্গ করার জন্য সীমিত জায়গা রেখে আগের চেয়ে বেশি ঘণ্টা কাজ করতে হবে।
সমাজবিজ্ঞানী শর্মিলা রুদ্রপ্পা ভারতের হায়দ্রাবাদের আইটি কর্মীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে দেখেছেন যে, কিভাবে ব্যক্তিরা তাদের জীবনের প্রথম দিকে বন্ধ্যাত্ব অনুভব করতে পারে না। কিন্তু পরিস্থিতি পরবর্তীতে তাদের বন্ধ্যাত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তারা অনায়াসে। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা তাকে জানায়, ব্যায়াম করার সময় নেই; তাদের নিজেদের জন্য রান্না করারই সময় হয়ে ওঠে না। এবং বেশির ভাগই কর্মব্যস্ততার মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য তাদের সময়ের অভাবের কথা জানান। কাজের চাপ তাদের ক্লান্ত করে দেয় ফলে সামাজিক বা যৌন ঘনিষ্ঠতার জন্য অল্প সময় পাওয়া যায়। যেমনটি পাকিস্তানের করাচিতে ৩৩ বছরের মেহরীন জানান, তিনি তার স্বামীর পাশাপাশি তার বাবা-মা এবং বৃদ্ধ দাদা-দাদীর সাথে থাকেন। তিনি এবং তার স্বামী উভয়েই পূর্ণ-সময় কাজ করেন এবং তারা সন্তান ধারণ করতে চাইলেও কাজ তাদের জীবনের একটি বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেহরীন একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে করপোরেট চাকরি করেন। তারা ‘প্রায় নিশ্চিত’ যে তাদের সন্তান হবে না। কারণগুলোর অন্যতম হচ্ছে সময়। মেহরীন বলেন, সন্তান নেয়ার মতো পুরো কার্যক্রমটি কতটা ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে তা হাস্যকর। আমি মনে করি আমাদের আগেকার প্রজন্ম এটিকে [বাচ্চাদের লালন-পালনের খরচ] বাচ্চাদের জন্য একটি বিনিয়োগ হিসেবে দেখেছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটাকে সেভাবে দেখি না। পুরনো প্রজন্মের অনেকেই সন্তান ধারণকে ভবিষ্যতে নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানের উপায় হিসেবে দেখেছে। শিশুরা বৃদ্ধ বয়সে তাদের পিতা-মাতার জন্য সময় ও অর্থ দুই দেবে। এটি আর এখনকার প্রজন্মের মধ্যে কাজ করে না। কারণ তরুণ প্রজন্ম তাদের পিতামাতা থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
অথচ মেহরীন ও তার স্বামী উভয়েই পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করছে। তারপরও সন্তান নেয়ার মতো সামাজিক প্রত্যাশা থেকে তারা দূরে অবস্থান করছেন। বরং প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘আমার স্বামী এবং আমি নিজেদেরকে সমান অংশীদার হিসেবে দেখি কিন্তু আমাদের নিজ নিজ মায়েরা কি আমাদের সমান অংশীদার হিসেবে দেখেন? হয়তো না।
সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বিশেষজ্ঞরা এবং সংস্থাগুলো বলছে, বর্ধিত ফ্লাইট টার্বুলেন্স থেকে শুরু করে জ্বলন্ত তাপপ্রবাহ এবং মারাত্মক বন্যা, পরিবেশগত ক্ষতির দুর্বল প্রভাব আগামী বছরগুলোতে জীবনকে আরো কঠিন করে তুলতে পারে। সিদ্দিকী বলেছেন যে তিনি পাকিস্তানে সাংবাদিক হিসেবে পরিবেশ নিয়ে প্রতিবেদন করার সময় বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সন্তান ধারণ করা সম্ভব হবে না।
বিচ্ছিন্নতার ভয় : সন্তানহীন ভবিষ্যৎ জীবন অবশ্য সিদ্দিকীকে আতঙ্কিত করে। যদিও তিনি বলেন বন্ধুদের সাথে একটি কমিউনে বাস করবেন। ভবিষ্যতে নিঃসঙ্গ হওয়ার ভয় মাঝে মধ্যে সিদ্দিকীর মনে জাগে। তাদের মতো ৩০ এর দশকের শেষের দিকের মহিলারা, সন্তান ধারণে আগ্রহী নন। অথচ তারা তাদের একা মারা যাওয়ার ভয়ের কথা বলে। সিদ্দিকী তার বন্ধুদের বলেছিলেন, এটি এমন কিছু যা আমাকে বেশ কিছুটা কষ্ট দেয়। কিন্তু এখন তিনি এটি ঝেড়ে ফেলেছেন। আশা করছেন এটি একটি অযৌক্তিক ভয়। সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি সন্তান নিতে চাই না শুধুমাত্র এই জন্য যে ৯৫ বছর বয়সে সে আমার যতœ নেবে। আমি মনে করি এটি হাস্যকর।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা