১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৭ বছর আজ

দ্বীপের সুরক্ষা বাঁধই অরক্ষিত, দুর্যোগে জানমালের ঝুঁকি

- ছবি : সংগৃহীত

যে বেড়িবাঁধ মানুষের জানমাল রক্ষা করবে, সেই বাঁধ নিজেই অরক্ষিত। কোথাও ভেঙে আছে, কোথাও নাজুক কিংবা দুর্বল অবস্থা। আবার কোথাও উচ্চতা কম। ৮০-৯০ দশক থেকে পরবর্তীতে নির্মিত পটুয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালীর বেশিভাগ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের অবস্থা এমনই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। কিন্তু বহু বছর আগে নির্মিত এসব বাঁধের উচ্চতা বাড়েনি। ফলে দুর্যোগকালীন জলোচ্ছ্বাসে কোথাও বাঁধ উপচে এবং কোথাও বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি ও মৎস্য পেশায় নির্ভরশীল মানুষজন।

শুক্রবার ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৭ বছর। ২০০৭ সালের এই দিনে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ভয়ানক এই ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু এর বছরের পর বছর গেলেও অরক্ষিত রয়েছে সাগর ও নদী বেষ্টিত দ্বীপ ‘রাঙ্গাবালী’।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দুর্যোগপ্রবণ এ জনপদের দুর্গম এলাকা চরনজির, চরকাশেম ও চরহেয়ার-এ এখনো বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি। ফলে দুর্যোগকালীন নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে সেখানকার মানুষের জীবনের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। শুধু এই তিন চর নয়, যেখানে বাঁধ আছে, সেখানকার মানুষেরও ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, উপকূলের মানুষের জানমাল সুরক্ষায় নির্মিত বাঁধগুলোর দশা অনেকটাই বেহাল।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য বলছে, ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ১৮৭ দশমিক ৯৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ বাঁধগুলোর উচ্চতা ছিল ৪ দশমিক ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৬ মিটার পর্যন্ত। বহু বছর আগে নির্মিত এ বাঁধগুলোর অবস্থা এখন নাজুক।

উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের নয়ারচর, বউবাজার, চরআন্ডা, চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের মধ্য চালিতাবুনিয়া, বিবির হাওলা, চরলতা, ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া, চরইমারশন, কাউখালী, মৌডুবি ইউনিয়নের কাজিকান্দাসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, কোথাও কোথাও বাঁধের উচ্চতা আছে এখন মাত্র দুই থেকে তিন মিটার। কোথাও বাঁধ ভেঙে আছে। কোথাও আছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম।

আরো দেখা গেছে, নতুন করে যেসব বাঁধ সংস্কার হয়েছে সেগুলোও টেকসই নয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার শঙ্কা স্থানীয় মানুষের।

আগুনমুখা ও ডিগ্রি নদী ঘেঁষা চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নেছার হাওলাদার বলেন, ‘নদী ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ আমরা। প্রতিবার বাঁধ ভেঙে বিলীন হয় বসতভিটা। এ পর্যন্ত দু’বার বাড়ির জায়গা বদলেছি। এরপর বাঁধ ভাঙলে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাবো সেটাই চিন্তা করতেছি। টেকসই এবং উঁচু করে ব্লক বাঁধ নির্মাণ করলে আমাদের বাঁধ ভাঙার আর কোনো ঝুঁকি থাকতো না।’

ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের চরইমারশন গ্রামের হেলাল খান বলেন, ‘ঝড়-বন্যা আমাদের নিত্যদিনের সাথী। সিডর, আইলা, মহাসেনসহ বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বাঁধ ভেঙে, বাঁধ উপচে পানি ঢুকে। পুকুর-ঘেরের মাছ ভেসে যায়। ফসল নষ্ট হয়। ঘর-বাড়ির ক্ষতি হয়।’

একই ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের বজলুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের গ্রামের এই বাঁধের উচ্চতা অনেক কম। কোথাও কোথাও মাত্র দুই-তিন মিটার। জোয়ারের পানি বাড়লেই বাঁধ ছুঁইছুঁই অবস্থা। আর ঝড়-বন্যা হলে পানি ঢুকে যায়। সহায়-সম্পদের ক্ষতি হয়। তাই বাঁধগুলো উঁচু করা খুবই প্রয়োজন।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পটুয়াখালী নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আরিফ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস যখন হয়, তখন স্বাভাবিকের চেয়ে পানির উচ্চতা বেশি থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন পানির উচ্চতা দুর্যোগকালীন সময়ে আরো বেশি হয়। যে কারণে জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। আমাদের আগের বেড়িবাঁধের উচ্চতা ছিল চার দশমিক তিন মিটার থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে রাঙ্গাবালীসহ বিভিন্ন উপজেলায় সাত থেকে সাড়ে সাত মিটার উচ্চতার বেড়িবাঁধ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই প্রকল্প এখনো প্লানিং পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পের ইনসেফশন রিপোর্ট তৈরি হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে কাজটি যাতে বাস্তবায়ন করতে পারি, সে লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে আলাপ চলছে। এটি এখনো অনুমোদিত হয়নি। প্রকল্প অনুমোদিত হলে বিশ্ব ব্যাংক কিংবা অন্য কোনো উন্নয়ন সংস্থা বাজেট দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হবে।’

যেসব চরে এখনো বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব জায়গায় বেড়িবাঁধ করা সম্ভব না। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিতে হয়। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয় কি না সেই সম্ভাবতা যাচাইয়ের বিষয় আছে। পরিবেশ ও মানুষের উপকার হয়, এমন স্থানে বেড়িবাঁধ করা হয়। সাগর ও নদী ঘেরা রাঙ্গাবালীর বাঁধগুলো স্থায়ী সুরক্ষা দেয়ার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা লাগবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে এতদিন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কিন্তু এখন আমরা যেখানে জনসংখ্যা বেশি এই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সেসব এলাকার বাঁধগুলো স্থায়ী সুরক্ষার পরিকল্পনা করেছি।’

এ ব্যাপারে জলবায়ু গবেষক ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. মো: শাহরিয়ার জামান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের যত ক্ষতিকর দিক রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া। সেইসাথে প্রচণ্ড খরা হওয়া, অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়া, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া। আমরা ৭০’ পরবর্তী অনেক ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। এরমধ্যে শুধু সিডরেই ১০ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে। আমরা একটি গবেষণায় দেখেছি, শুধু বাংলাদেশে ০.৩ মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ০.৫ মিলিয়ন টন ধানের উৎপাদন কমে গেছে।’


আরো সংবাদ



premium cement
আইন মন্ত্রণালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে গৃহীত কার্যক্রম দুই ম্যাচ হাতে রেখেই ইংল্যান্ডের সিরিজ জয় সরকার ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে অগ্রগতি করছে : অর্থ উপদেষ্টা কুষ্টিয়া ষ্টেডিয়ামের নাম ‘শহীদ আবরার ফাহাদ ষ্টেডিয়াম’ সরকারি নির্মাণে পোড়া ইট ব্যবহার ২০২৫ সাল নাগাদ বন্ধ হবে : রিজওয়ানা হাসান ‘আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল’ দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার অবনতি ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ৩ মাস বন্ধ থাকার পর চালু হচ্ছে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন রাজধানীতে ডাকাতের ছুরিকাঘাতে প্রবাসী চিকিৎসক নিহত দ্বীপের সুরক্ষা বাঁধই অরক্ষিত, দুর্যোগে জানমালের ঝুঁকি

সকল