স্বজন হারানো ভয়াবহ স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও কাঁদে অনেকে
- রবিন আহম্মেদ, পায়রা বন্দর (পটুয়াখালী)
- ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৪, আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৮
এমন কোনো গ্রাম কিংবা বাড়ি ছিল না, যেখানে কেউ প্রাণ হারায়নি। বাড়ি, পুকুর, খাল-বিল ও নদী-নালায় ছিল লাশের মিছিল। মহা প্রলয়ঙ্কারী এক ঘূর্ণিঝড়ে মরণপুরীতে রূপ নিয়েছিল পটুয়াখালীর সাগরের বুকে জেগে থাকা দ্বীপ ‘রাঙ্গাবালী’। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠেছিল দ্বীপের আকাশ বাতাস। ৫৪ বছর আগের ভয়াবহ এমন স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছে অনেকে। স্বজন হারানো বিভীষিকাময় দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে উঠেন তারা।
মঙ্গলবার সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এই দিনে মহা প্রলয়ঙ্ককরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বেলা গড়িয়ে রাত নামতেই ফুঁসে ওঠে সাগর। তীব্র বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসে উঁচু উঁচু ঢেউ। সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে লোকালয়ের ওপর। মুহূর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষ, গবাদি পশু, বাড়ি-ঘর, ক্ষেতের ফসলসহ সহায়-সম্পদ। দক্ষিণের এ উপকূল মুহূর্তেই ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। নিচিহ্ন হয়ে যায় অনেক বসতবাড়ি।
জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ৭০-এর এই ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ‘গোর্কি’ কিংবা ‘ভোলা সাইক্লোন’ নামের এ ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপ রাঙ্গাবালীতে ওই দিন অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। যদিও সরকারিভাবে এর কোনো সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি।
তবে এ প্রতিবেদন করতে গিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন কোনো গ্রাম কিংবা বাড়ি পাওয়া যায়নি যেখানে কেউ না কেউ মারা যায়নি। স্বজন হারানো সেই স্মৃতি মনে পড়লে আজও কাঁদেন অনেকে। তাদেরই একজন আব্দুল জলিল মৃধা, বয়স ৮৫ বছর। তার বাড়ি সদর ইউনিয়নের পুলঘাট বাজার সংলগ্ন সেনের হাওলা গ্রামে। ‘ফজলু চেয়ারম্যান বাড়ি’ কিংবা ‘মৃধা বাড়ি’ নামেই তাদের বাড়িটি পরিচিত। বড় দোতলা ঘর থাকায় আশপাশের লোকজন তাদের বাড়িতে ছুঁটে এসেছিলেন। প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসা তিন থেকে সাড়ে তিন শ’ মানুষ ওই দিন ঘর চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। প্রাণ হারিয়েছিল জলিল মৃধার মা এবং বোনও।
কান্না জড়িত কণ্ঠে প্রতিবেদকের সাথে এমন বর্ণনা দিয়েছেন জলিল মৃধা। তিনি বলেন, ‘গাছে উঠে তার প্রাণ বেঁচেছিল ওই দিন। তাদের বড় টিনশেড দোতলা ঘরে আশ্রয় নেয়া তিন থেকে সাড়ে তিন শ’ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ঘরটি চাপা পড়ে মানুষ মারা যান। দুই দিন পর বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে ঘর উল্টানোর পর লাশগুলো বের হয়। তখন তার মা আর বোনের লাশও পাওয়া যায়।’
জলিল মৃধার মতো এমন স্মৃতি বয়ে আজও যারা বেঁচে রয়েছেন কিংবা স্বজনদের হারিয়েছেন কেবল তারাই অনুভব করেন ওই দিনের ভয়াবহতা। ঘূর্ণিঝড়টির আঘাত এবং জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা এতই নির্মম ছিল যে ওই দিনের কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে শিহরে ওঠে ওই দিনের বেঁচে থাকা মানুষের প্রাণ। ওই দিনের ঘূর্ণিঝড়ে মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া অনেকেই বলছেন বাড়ি, পুকুর, খাল-বিল ও নদী-নালায় ছিল লাশ আর লাশ। পানিও দূষিত হয়ে গিয়েছিল। বিশুদ্ধ পানি এবং খাবারের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছিল।
মা-বাবা হারানোর স্মৃতি বয়ে বেড়ানো উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের চরইমারশন গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৯০) বলেন, ‘আমার মা-বাবা দু’জনেই মারা গেছে। আমি আর আমার এক ভাই গাছে উঠে আমি বেঁচে গেছি। পরিবারের আর কাউকে পাইনি। চোখের সামনে ৮০ থেকে ৯০ জন মানুষ মারা গেছে। আমাদের বাড়ির ছয়টি ঘরে আশ্রয় নেয়া বেশিভাগ মানুষ মারা গেছে। গাছে উঠেও কেউ কেউ রেহাই পায়নি।’
তিনি বলেন, ‘সকালে আহাজারি করেছি, আর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দৌড়েছি মা-বাবাকে খুঁজতে। পানি কমার পর বাবাকে পাই। চারদিন পর মাকে একটি গাছের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাই।’
তবে গত কয়েক দশক ধরে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য উপকূলীয় এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি অনেকটাই কমেছে। কিন্তু নদী ও সাগর বেষ্টিত এই দ্বীপ দুর্যোগপ্রবণ হওয়ায় ৭০’ পরবর্তী প্রায় সব কয়টি ঘূর্ণিঝড়েই সেখানে সহায়-সম্পদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ৭০’-এর ঘূর্ণিঝড়ের ৫৪ বছর হলেও দ্বীপ রাঙ্গাবালীর চরকাশেম, চরহেয়ার, চরনজিরসহ সাত থেকে আটটি চর এখনো অরক্ষিত। এর কোথাও নেই বেড়িবাঁধ, কোথাও নেই আশ্রয়কেন্দ্র। কোথাও নেই কোনটিই। আবার কোথাও বাঁধ থাকলেও ভাঙা। আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও জনসংখ্যা অনুপাতে অপ্রতুল। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই সব চরের মানুষের জীবন থাকে চরম সঙ্কটে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে টেকসই এবং উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি জনসংখ্যা অনুপাতে আরো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রয়োজন।
প্রযুক্তির উন্নয়নে এখন আবহাওয়ার আগাম বার্তায় ক্ষয়ক্ষতি কম হলেও এখনো উপকূলের মানুষকে রক্ষায় মহাপরিকল্পনা হচ্ছে না, এমনটাই মনে করছেন উপকূলীয় এলাকা নিয়ে কাজ করা মানুষেরা।
জলবায়ুর প্রভাব ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় করণীয় বিষয় নিয়ে রাঙ্গাবালীতে কাজ করা বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা মোহসীন তালুকদার বলেন, ‘উপকূলবাসীর ন্যায্যতা ও অধিকার আদায়ের কথা তুলে ধরতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। পাশাপাশি উপকূলের পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করতে উপকূলের ১৯টি জেলা নিয়ে উপকূল মন্ত্রণালয় করা যেতে পারে।’
উপকূলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি, এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার পাশাপাশি উপকূলবাসীর ন্যায্যতা ও অধিকার আদায়ের কথা তুলে ধরতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে ঘোষণার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা