১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সুনামগঞ্জে কৃষকের ধান কিনছেন দালালরা

ধানের মাপে শুভঙ্করের ফাঁকি

-

- ঠকছেন কৃষকরা
- ইউনিয়নভিত্তিক পয়েন্টে সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের দাবি

সুনামগঞ্জের হাওরে কৃষকদের ধান কাটা শেষ। ঈদ সামনে রেখে গ্রামে-গ্রামে চলছে নতুন ধান কেনা-বেচা। ধান বুঝে দর দাম ঠিক করছেন পাইকাররা। স্থানীয় ভাষায় ধান কেনার পাইকারকে দালাল বলে অভিহিত করেন বিক্রেতারা।
কৃষকের সারা বছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল ধান বিক্রির সময় শুভঙ্করের ফাঁকিতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের আগেই অনেক কৃষকের গোলা ধানশূন্য হচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি ও মহাজনী ঋণ শোধ করতে ধান কাটার সাথে সাথেই কম দামে ধান বিক্রি করতে হয় তাদের। সরকারিভাবে ধান ক্রয় শুরুর আগেই কৃষকরা ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা দরে (প্রতি মণ) ধান বিক্রি করে দিয়েছেন স্থানীয় ব্যাপারীদের (দালাল) কাছে। সরকারিভাবে সুনামগঞ্জে এবার ২৯ হাজার ১১ মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ৩২ টাকা কেজি দামে প্রতি মণ ধান এক হাজার ২৮০ টাকা দরে ক্রয় করা হবে খাদ্যগুদামে।
তবে অনেক কৃষকের অভিযোগ, একশ্রেণীর দালাল চক্র কৃষকদের কৃষি কার্ড সংগ্রহ করে তাদের নামে ধান বিক্রি করে, কার্ডধারী কৃষককে যৎসামান্য টাকা বিনিময় করে থাকেন। ইউনিয়নভিত্তিক পয়েন্টে সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের দাবি জানান কৃষকরা।
এবার জেলার মল্লিকপুর খাদ্যগুদামে এক হাজার ১৭৫ মেট্রিক টন, শান্তিগঞ্জে দুই হাজার ৯৯৪, দোয়ারাবাজারে এক হাজার ৫৩৬, ছাতকে, জগন্নাথপুরে, রানীগঞ্জে, দিরাইয়ে চার হাজার ৭১৮, গুঙিয়ারগাঁওয়ে তিন হাজার ৪৯৮ টন, ধর্মপাশায় এক হাজার ৫০০, মধ্যনগরে দুই হাজার ৩৯৫, সাচনায় তিন হাজার ১২৬, তাহিরপুরে দুই হাজার ৪৯৮ ও বিশ্বম্ভরপুরে দুই হাজার ৪৫৫ মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামের কৃষকরা সরকারিভাবে ধানক্রয়ের কথা এখনো জানেন না। বৈশাখে উৎপাদিত ধান বিক্রিতে ঠকছেন, আবার জীবন বাঁচাতে এই কৃষকদেরই চাল কিনতে হয় বেশি দামে। এ যেন শাখের করাতে তাদের জীবন বন্দী। বহুমুখী সমস্যা, ভোগান্তি ও প্রতারণা যেন পিছু ছাড়ছেনা কৃষকদের।
পাকনা হাওরের কৃষক কয়েছ মিয়া জানান, ৩৩ শতক জমিতে বিআর-২৮ ধান চাষে সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে সর্বোচ্চ ১২-১৬ মণ। শ্রমিকের মজুরি আর ঋণ দিয়ে গড় পরতায় তেমন ধান থাকে না।
সরকারি ধান সংগ্রহের আগেই দালাল বা কয়ালরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে ধান মাপতে এক ধরনের বিশেষ গণনারীতি ব্যবহার করে। দালালরা ধান মাপার শুরুতেই অঙ্কের ‘লাভে রে লাভ, লাভে রে লাভ (এক), দুইয়া, তিনেরে, চাইরো এভাবে ‘নাইশা’ (উনিশ), ‘উনদিশা (ঊনত্রিশ), ‘অইনচা (ঊনচল্লিশ), চাইলা (চল্লিশ), পর্যন্ত বিকৃত উচ্চারণ করে। আর এতে যুগের পর যুগ ধান বিক্রিতে হাওরের সহজ সরল কৃষকরা ঠকছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ধান ক্রয়-বিক্রয়ে এখনো দাঁড়িপাল্লা ব্যবহৃত হয়। কিছু কিছু মিটারেও মাপা হয় তবে মিটারে ৪২ পয়েন্টে মণ ধরা হয়।
কৃষকরা জানায়, কয়াল-দালালরা এক তালে ‘চল্লিশ পাল্লা বা পাঁচ মণ ধান মাপার পর দৃশ্যমানভাবেই প্রায় দুই কেজি ধান অতিরিক্ত নেন।
হাওরের ধান, মৎস্য ও পাথর সম্পদ দিয়েই হাওরবাসী জাতীয় অর্থনীতিতে যে জোগান দেয়, তার আংশিক ব্যবহার হলে হাওরবাসীর অনেক সমস্য সমাধান হতো বলে জানান কৃষকরা। বাংলার শস্য ভাণ্ডার হাওর-ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, সিলেট ও বি, বাড়িয়া জেলা নিয়ে গঠিত প্রায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল আয়তনের। এই হাওর এলাকায় প্রায় দুই কোটি লোক বাস করেন। হাওরে একটি মাত্র ফসল-ধান চাষ হয়। দেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ধান এ হাওরে উৎপাদিত হয়। ধান কেনার দালাল-কয়াল রমিজ আলী বলেন, আমরা মাপে কারচুপি করি না। ধান কাটার সময় কৃষকের হাতে টাকা থাকে না তাই কম দামে ধান বিক্রি করে কৃষকরা।
সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মইনুল ইসলাম ভূঁইয়ার কাছে এ বিষয়ে জানতে তার মেবাইলফোনে কল দিলে তিনি বলেন, সরকারিভাবে প্রতি কেজি ধান ৩২ টাকা দরে মণপ্রতি এক হাজার ২৮০ টাকা নির্ধারণ হয়েছে। লটারির মাধ্যমে ধান ক্রয় শুরু হয়েছে। প্রকৃত কার্ডধারী কৃষকদের ধানের আর্দ্রতা ও গুণগতমান দেখে ক্রয় করা হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement