১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আদমদীঘিতে ২৩০ চালকল বন্ধ বেকার ৭ হাজার শ্রমিক

স্বয়ংক্রিয় চালকলের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একের পর এক বন্ধ হতে থাকে সাধারণ চালকল
-


একটানা লোকসানে ব্যবসার মূলধন হারানোর কারণে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলায় ২৩০টি চালকল (হাসকিং মিল) বন্ধ হয়ে গেছে। এসব চালকলের মধ্যে ১৭৮টি একেবারে বন্ধ এবং ৫২টি চালকল সরকারের সাথে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক চাল সরবরাহ করতে না পারায় তাদের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। বর্তমানে উপজেলায় ৫৪টি সাধারণ চালকল (হাসকিং) এবং ১১টি স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটিক) চালকল চালু রয়েছে। অধিকাংশ চালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চালকলের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সাত হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় মোট সাধারণ চালকল ২৮৪টি এবং স্বয়ংক্রিয় চালকল ১৪টি। সরকারের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করায় ৫২টি সাধারণ চালকল এবং তিনটি স্বয়ংক্রিয় চালকলের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। বর্তমানে ১১টি স্বয়ংক্রিয় এবং ৫৪টি সাধারণ চালকল চালু রয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে উপজেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ৭০০ টন। সংগৃহীত চালের মধ্যে প্রায় চার হাজার টন সরবরাহ করেছে স্বয়ংক্রিয় চালকল। বাকি ৭০০ টন সরবরাহ করেছে সাধারণ চালকল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধান সমৃদ্ধ এলাকা এবং দেশের সর্ববৃহৎ খাদ্য গুদাম (সান্তাহার সিএসডি ও সাইলো) এই উপজেলায় অবস্থিত হওয়ায় ৯০ দশকের পর থেকে ব্যাঙের ছাতার মতো এখানে চাতাল ব্যবসা গড়ে ওঠে। অনেকে ফসলের জমিতেই চাতাল তৈরি করে চালকলের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় ভালো মুনাফা হওয়ায় এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকলেও একপর্যায়ে এর গতি থেমে যায় ২০০০ সালের পর থেকে এলাকায় একের পর এক স্বয়ংক্রিয় চালকল গড়ে ওঠায়। ধান সিদ্ধ ও শুকানো ছাড়াই স্বয়ংক্রিয় চালকলে সরাসরি কাঁচা ধান থেকে দ্রুত চাল উৎপাদন হওয়ায় থেমে যায় সাধারণ চালকলের ব্যবসা। স্বয়ংক্রিয় চালকলের সাথে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লোকসানে পড়ে একের পর এক সাধারণ চালকল বন্ধ হতে থাকে।

সান্তাহার শহরের মুসফিক চালকলের স্বত্বাধিকারী মতিউর রহমান জানান, তার একটি সাধারণ চালকলে ১৫ দিনে ধান ছাটাইয়ের ক্ষমতা ১৫৪ টন। প্রতি দিন ধানের প্রয়োজন হয় ১৪০ বস্তা (প্রতি বস্তা ৭৫ কেজি)। কিন্তু শহরের বৈশাখী নামে স্বয়ংক্রিয় চালকলে ১৫ দিনে তিনটি ইউনিটে ছাঁটাই ক্ষমতা ৪৮ হাজার টন। প্রতি দিন এই চালকলে ধান প্রয়োজন হয় তিন হাজার টনেরও বেশি। উৎপাদন ক্ষমতার বিশাল ব্যবধানের সাথে তালমেলাতে না পারার কারণে বন্ধ হতে থাকে একের পর এক সাধারণ চালকল।
চালকল ব্যবসায়ী হেলালুর রহমান বলেন, নানা কারণে স্বয়ংক্রিয় চালকল ব্যবসায়ীদের সাথে আমরা টিকতে পারছি না। এর অন্যতম কারণ ধান থেকে চাল উৎপাদনের আনুপাতিক হার। সাধারণ চালকলে প্রতি মণে ধান থেকে চাল উৎপন্ন হয় ২৫ কেজি অথচ স্বয়ংক্রিয় চালকলে প্রতি মণে উৎপন্ন হয় প্রায় ২৮ কেজি। সাধারণ চালকলে ধান থেকে গুঁড়া ও তুষ বের হয়, যার মূল্য অনেক কম। পক্ষান্তরে স্বয়ংক্রিয় চালকলে ৬০০ মণ ধান থেকে চালের কুঁড়া বের হয় প্রায় ৪০ বস্তা। এসব কুঁড়া প্রতি ৫০ কেজি ওজনের বস্তার মূল্য প্রায় দুই হাজার টাকা। চালের কুঁড়া থেকে ভোজ্যতেল ও মাছসহ পশু খাদ্য তৈরি হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। এ ছাড়া স্বয়ংক্রিয় চালকল মালিকরা স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের লোন পাওয়ায় ধান কাটার পর পরই বেশি পরিমাণ ধান কিনে রাখতে পারেন, যেটি সাধারণ চালকল মালিকরা পারেন না।
ব্যবসায়ী মতিউর রহমান আরো বলেন, বর্তমানে বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় চাল তৈরি করে লাভ হচ্ছে না। প্রতি মণ ধান কেনাসহ চাল উৎপাদন খরচ পড়ছে প্রায় ২৪ শ’ টাকা। কিন্তু চাল বিক্রি হচ্ছে ২,২৫০ টাকা। প্রতি মণে লোকসান হচ্ছে দেড় থেকে দুই শ’ টাকা। আদমদীঘি উপজেলার আরেক ব্যবসায়ী হানিফ উদ্দিন জানান, দুই শ’র বেশি চালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গেছেন। এসব শ্রমিকরা বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মতি চালকলের নারী শ্রমিক রেহেনা বেগম, মর্জিনা বেগম, আনিসুর ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা বর্তমানে বেকার। পরিবারের সদস্যরা এক বেলা খেয়ে দুবেলা না খেয়ে দিন পার করছেন। কেউ কেউ এ পেশা ছেড়ে বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছেন।
আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা গোলাম রব্বানী সাধারণ চালকল বন্ধ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, স্বয়ংক্রিয় চালকলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, ধানের দাম বেড়ে যাওয়া ও মূলধন হারানোসহ বিভিন্ন কারণে সাধারণ চালকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement