২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ২১ শাবান ১৪৪৬
`

দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি চায় তিস্তাপাড়ের মানুষ

তিস্তার বালুচর পাড়ি দিয়ে অসুস্থ মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে দুই ভাই : নয়া দিগন্ত -

খরস্রোতা তিস্তা নদীর ডান তীরের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম হঠাৎ মধ্যরাতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথায় মুমূর্ষু অবস্থায় দুই ছেলে রবিউল ও শাফিউল জলচকিতে সাই (দোলা) সাজিয়ে কাঁধে করে তিস্তার বালুচরের ১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মাকে নিয়ে যাচ্ছেন কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। মায়ের চিকিৎসা করাতে।
এমন দৃশ্য শুধু শুষ্ক মৌসুমেই নয়, সারা বছরই। তিস্তা পাড়ের চরের মানুষকে এভাবেই প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে জীবনযাপন করতে হয়। বর্ষাকালে তিস্তায় পানি বৃদ্ধির কারণেও চর অঞ্চলের মানুষদের পড়তে হয় মহাবিপদে। হাট-বাজার করা, শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে পড়ানোসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও তারা চরম বিপদে পড়েন। পরিবারের কেউ মারা গেলে স্বাভাবিকভাবে কবরস্থ করতে পারেন না তারা। অন্যদিকে স্বাভাবিক যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় তিস্তার চরের মানুষের সাথে সামাজিক সম্পর্কও করতে চান না অনেকে।
ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার ও পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় তিস্তা পাড়ের মানুষের এমন বেহাল দশা। অথচ এই তিস্তাই ছিল উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তিস্তায় যখন পানির প্রয়োজন হয় না, তখন তিস্তা থাকে শুষ্ক বালুচর। আর যখন পানির প্রয়োজন পড়ে না, তখন পানি ছেড়ে দিয়ে তিস্তা পাড়ের মানুষদের ডুবিয়ে মারে উজানের দেশ ভারত। বর্ষা মৌসুমে ভারত অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে লালমনিরহাট জেলাকে কয়েক দফায় বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চরের অর্থনীতি। তলিয়ে যায় খেত খামার ফসল ও বসতবাড়ি। আবার তিস্তা বানের পানি কমতে শুরু করলেও পড়তে হয় আরেক বিপদে। পানি কমার সাথে সাথে শুরু হয় ভয়াল ভাঙন। ভাঙতে শুরু করে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমির মাঠ। গত ২০২৪ সালের বর্ষা মৌসুমে পঞ্চম দফা বন্যার কবলে পড়ে তিস্তা পাড়ের মানুষ।
এক সময় তিস্তার উত্তরাঞ্চলের বিশেষ করে লালমনিরহাটের মানুষের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। উজানের দেশ ভারত বছরের পর বছর পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার কারণে এখন এ অঞ্চলটি মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
আন্তঃসীমান্ত তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিমি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলা নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের ওপর দিয়ে নদীর ১১৫ কিমি প্রবাহিত হয়েছে। তার মধ্যে শুধুমাত্র লালমনিরহাটের বাম তীরেই রয়েছে ৬৮ কিলোমিটার তিস্তাপাড়। এই পানি প্রত্যাহার ও আগ্রাসী কায়দায় হঠাৎ পানি ছেড়ে দেয়ায় খরস্রোতা তিস্তা নদীর আগ্রাসীরূপ লালমনিরহাটের মানুষকে সর্বশান্ত করে দেয়।
উত্তরাঞ্চলের মানুষের দুঃখ তিস্তা পাড়ের মানুষের এই দুর্দশায় আশা জাগিয়েছে চীন সরকারের প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা। চীনের হোয়াং হো নদকে এক সময় বলা হতো চীনের দুঃখ। সেই নদকে শাসন করে জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটি গড়ে তুলেছে চীন সরকার। সেই মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে চীনের হোয়াং হো নদী ও সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়কে আধুনিকভাবে গড়ে তোলার এই মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে মেরিন ড্রাইভ। তৈরি হবে আধুনিক সেচ প্রকল্প ও যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ কৃষি খামার। একই সাথে নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠা তিস্তা স্যাটেলাইট শহর গড়ার পরিকল্পনাও রয়েছে এই মহাপরিকল্পনায়।
এরই লক্ষ্যে ২০২২ সালের ৯ অক্টোবর বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় অবস্থিত তিস্তা নদীর ওপরে অবস্থিত তিস্তা ব্যারেজ এলাকা পরিদর্শন করেন। কিন্তু ভারত সরকারের বিরোধিতায় ও আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে আটকে যায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা।
সম্প্রতি ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা। এরই মধ্যে তিস্তা পাড়ে এসে গণ-শুনানি করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা। এরা হলেন- পরিবেশ ও পানি সম্পদ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান এবং যুব ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।


আরো সংবাদ



premium cement