১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৬
`

দুধ বিক্রি করে খরচ উঠছে না লোকসানে খামারিরা

রাউতরা বাথানে রাখালরা গাভীর সংরক্ষণ করছেন : নয়া দিগন্ত -


পাবনা ও সিরাজগঞ্জে মিল্কভিটা ও ব্যক্তি মালিকাধীন ৪০০ বাথানের দিগন্ত বিস্তীর্ণ চারণভূমিতে উন্নতজাতের প্রায় লক্ষাধিক গরু বিচরণ করছে। এসব গরুর আয়ের ওপর নির্ভরশীল প্রায় দুই লাখ পরিবার। বাথান থেকে প্রতিদিন সংগ্রহ করা হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া মুক্ত দেড় লাখ লিটারেরও অধিক খাঁটি তরল দুধ।
এই দুধ সরবরাহ করা হয় সরকারি-বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে। দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গোখামারিদের উৎপাদিত দুধ কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ উঠছে না। এদিকে গোখাদ্যের উচ্চমূল্য ও অব্যাহত লোকসানে অনেকেই খামার বন্ধ করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
শতাব্দীর প্রাচীনকাল থেকে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের গোখামারি ও কৃষকরা উন্নতজাতের পাক-ভারতের জার্সি, ফ্রিজিয়ান, এফএস, শাহিওয়াল, সিন্ধি, হরিয়ানা ও মুলতানি গরু লালন-পালন করে আসছেন। এ অঞ্চলের গোসম্পদের ভবিষ্যৎ এবং গোসম্পদকে অর্থকরী সম্পদে রুপ দিতে স্বাধীনতার পর বাঘাবাড়ী বড়াল নদী পাড়ে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা কারখানা স্থাপন করা হয়।

জানা গেছে, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির দৌরাত্ম্যে মিল্কভিটার আওতাভুক্ত বিস্তীর্ণ গোচারণ ভূমির কিছু অংশ বেহাত হয়ে গেছে। তারা গোচারণ ভূমির প্রায় ৫৫০ একর জমি জাল দলিল ও পত্তনির মাধ্যমে দখল করে নিয়েছেন। সেসব জমিতে এখন ঘাসের পরিবর্তে বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। বর্তমানে ব্যক্তি পর্যায়ে খাস জমি এবং মিল্কভিটার নিয়ন্ত্রণাধীন বাথান অঞ্চল যেটুক রয়েছে, তারও যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা যায়। ফলে প্রতি বছরই বাথানে গরুর বিচরণক্ষেত্র ও দুধ উৎপাদন প্রতি বছর কমছে। বিগত বছরগুলোতে বাথানে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হতো। বর্তমানে উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ লিটার।

জানা যায়, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী-নিমাইচরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একটি অংশ (রাউতরার কাছে অস্থায়ীভাবে নির্মিত রিং বাঁধ) প্রতিবছর আগাম বন্যায় ভেঙে গোচারণ ভূমি তলিয়ে যায়। অথচ আধা কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হলে গবাদিপশু কমপক্ষে ৯ থেকে ১০ মাস বাথানে বিচরণ করতে পারে। এতে খামারিদের লাখ লাখ টাকা সাশ্রয় হতো। গোখাদ্য খড়, ভুসি, খৈল, লালির উচ্চমূল্যের কারণে খামারিরা এখন আর পুষিয়ে উঠতে পারছেন না। তাই তারা সরকারি-বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজার দরের সাথে সমন্বয় করে দুধের দাম বাড়ানোর দাবি তুলছেন। তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে নামমাত্র দামে দুধ কিনছেন। মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো গোসম্পদ উন্নয়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী গোসম্পদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে বলে তারা জানান।

সরকারি ও বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে চার দশমিক শূন্য স্ট্যান্ডার্ড ননিযুক্ত তরল দুধ বোনাসসহ ৫০-৫৫ টাকায় কিনে। এরপর সেই দুধ থেকে ননি বের করে নেয়া হচ্ছে। পরে তিন দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননিযুক্ত তরল দুধ প্যাকেটজাত করে ৯০ টাকা দরে তারা বিক্রি করছেন। তবে ভোক্তা পর্যায়ে এ দুধ বিক্রি লিটারপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকা দরে।
এ ছাড়া প্রতি লিটার দুধ থেকে শূন্য দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননি তুলে ঘি তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রতি লিটার দুধ থেকে ৭০ টাকার ঘি উৎপাদিত হচ্ছে। সবমিলে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধে প্রায় ১৬০ টাকা আয় করছে। তাদের প্রতি লিটার দুধে লাভ থাকছে ১০৫ টাকা। এদিকে অব্যাহত লোকসানের মুখে কৃষক ও খামারিরা এ পেশাকে অলাভজনক হওয়ায় খামার ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। এ কারণেই খামারীরা দুধের দাম বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছেন।
শহজাদপুর উপজেলার চরাচিথুলিয়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সদস্য সোহেল রানা, ইউসুফ আলী, রওশন আলী, আব্দুল আলীমসহ কয়েকজন জানান, খামারিরা দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানে ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা লিটার দরে প্রতি দুধ বিক্রি করছেন। এতে তাদের উৎপাদন খরচ উঠছে না। এদিকে গোখাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি ৩০০-৪০০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা আরো লোকসানে পড়েছেন। অনেক খামারি লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে সম্ভাবনাময় দুগ্ধ শিল্পের বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে।

গবাদিপশুর মালিকরা জানান, একক মালিকানায় বর্তমানে বাথানের সংখ্যা নেই বললেই চলে। পাঁচ থেকে ১৫ জন মিলে একত্রে একটি বাথানে আয়তন ভেদে ৪০০ থেকে ৯০০ গরু রাখেন। এসব খামার মালিকদের প্রায় প্রতিদিনই একবার করে বাথানে যেতে হয় খোঁজখবর নিতে। তবে তাদের বেশির ভাগ সময় কাটে খৈল-ভুসি-লালি সরবরাহ ও দুধের দাম ইত্যাদি সংগ্রহ করতে। খামার মালিকদের নিয়োজিত রাখালরা সার্বক্ষণিক বাথানে অবস্থান করেন। পুরোপুরি এদের ওপরই নির্ভর করতে হয় গরুর মালিকদের।

 


আরো সংবাদ



premium cement