ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ আর শোনা যায় না গ্রামবাংলায়

গ্রামবাংলায় ভোরের আলো ফুটতেই ঢেঁকির ছন্দময় শব্দে যে দিন শুরু হতো, সে দিনগুলো যেন স্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ, কৃষাণীদের প্রাণবন্ত হাসি, আর ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ গানগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। যান্ত্রিক যুগের দাপটে, ঢেঁকি শিল্প ক্রমে বিলুপ্তির পথে।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কাইউনের ঘগোয়ার পাড় গ্রামের আব্দুল করিমের বাড়িতে দেখা যায়, আধুনিকতার মধ্যেও ঢেঁকি দিয়ে চালের আটাসহ ধান ভাঙার কাজ এখনো চালু রয়েছে। আব্দুল করিমের স্ত্রী হাদা বেগম বলেন, ‘ঢেঁকির ছাঁটা চালের ভাত এবং পিঠার স্বাদ অতুলনীয়। আধুনিক মেশিনে তৈরি চাল ও গুড়ায় সেই স্বাদ পাওয়া যায় না।’
অন্য দিকে উপজেলার সাবেক ছিটমহল দাসিয়ার ছড়ার কামালপুর ভাটিয়াটারী গ্রামের তাজুল ইসলামের বাড়িতেও দেখা যায় ঢেঁকি দিয়ে ধান ভাঙার দৃশ্য। তাজুল ইসলামের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, ঢেঁকি শিল্পকে টিকিয়ে রাখা শুধু কর্মসংস্থানের জন্য নয় বরং এটি এ দেশের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অংশ।
ফুলবাড়ী উপজেলায় এক সময় প্রতিটি গৃহস্থের বাড়িতে ঢেঁকি ছিল অবিচ্ছেদ্য। তবে এখন তার স্থান দখল করেছে বৈদ্যুতিক কিংবা ডিজেল চালিত শ্যালো মেশিন। এসব মেশিনে ধান ভাঙানোর বিকট শব্দ শুধু গ্রামীণ পরিবেশের সৌন্দর্য নষ্ট করছে না, বরং কর্মসংস্থানেও প্রভাব ফেলছে।

ফুলবাড়ী সদর ইউনের নাগদাহ ওয়ার্ড সদস্য সাইফুর রহমান জানান, ‘গ্রামে এখন ঢেঁকি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঢেঁকির ছাঁটা চাল বা পিঠা তৈরির চালের গুঁড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কয়েক বছর আগেও বড় গৃহস্থের বাড়িতে একাধিক ঢেঁকি দেখা যেত।’
এক সময় ঢেঁকি দিয়ে ধান ভাঙা শুধু গৃহস্থালী কাজ ছিল না; এটি ছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। মহিলারা একত্রে ধান ভাঙার সময় গান, গল্প আর হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠতেন। ঢেঁকির তালে তালে বিভিন্ন গ্রামীণ গীত ও শ্লোক উচ্চারণে মুখর থাকত পরিবেশ।
ফুলবাড়ী উপজেলা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদফতরের উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তা আজমল আবসার জানান, ‘আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে ঢেঁকি শিল্প ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। আধুনিক চাল কল, রাইস মিল ইত্যাদি যন্ত্রপাতি ঢেঁকির চেয়ে অনেক দ্রুত এবং বেশি পরিমাণে ধান ভাঙতে সক্ষম। ফলে সময় ও শ্রম বাঁচাতে চাষিরা এই যন্ত্রপাতির দিকে ঝুঁকছেন।’
ঢেঁকি শিল্পের প্রতি যতœশীল হলে, এটি শুধু আমাদের ইতিহাসই বাঁচাবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের শেকড়ের সঙ্গে পরিচিত করবে।