২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
লালমনিরহাটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

৫ আগস্ট ৬ শিক্ষার্থীর আগুনে মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন হয়নি

তালাবদ্ধ এই বাড়িতেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয় ছাত্রদের : নয়া দিগন্ত -

চলতি বছরের ৫ আগস্ট সকালে হাসিনা সরকার পতনের আগে সারা দেশের মতো লালমনিরহাটও ছিল আন্দোলনে উত্তাল। আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল লালমনিরহাটের প্রতিটি সড়কে, পাড়া-মহল্লায় ও গ্রামে। দুপুরের পর হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর জেলার চার দিকে ছিল জনতার উচ্ছ্বাস। জেলায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা ছয় ছাত্র আনন্দ মিছিল শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ হওয়া শিক্ষার্থীদের হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজির পর রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সুমন খানের পুড়ে যাওয়া পাঁচতলা বাড়ি থেকে তাদের তাদের অঙ্গার দেহ উদ্ধার হয়। অগ্নিকাণ্ডের সময় বাড়িটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল।

আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শিক্ষার্থীরা হলেনÑ লালমনিরহাট পৌরসভার হাড়িভাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা ও জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি মৃত জাহিদুল ইসলাম খোকনের ছেলে আল শাহরিয়ার তন্ময় (২২), লালমনিরহাট পৌরসভার নবীনগর নর্থবেঙ্গল মোড়ের মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে ছাত্র জনি মিয়া (১৮), লালমনিরহাট সরকারি কলেজের ছাত্রদলের সাবেক ভিপি সাইদুর রহমান মিঠুলের ছেলে ড্যাফোডিলের প্রথম বর্ষের ছাত্র শাহরিয়ার শ্রাবণ (১৯), পৌরসভার বসুন্ধরা এলাকার জহুরুল হক সরকারের ছেলে জোবায়েদ হোসেন জিসান (১৬), পাশের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা বড়লই গ্রামের জিয়াউর রহমানের ছেলে রাদিফ হোসেন (১৭), একই জেলার রাজারহাট জয়কুমুর গ্রামের রেজাউল করিম সরকারের ছেলে রাজিব-উল-করিম (১৮)।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা ছয় ছাত্রের সবার বাসা সদর উপজেলায়। পরিবারের সদস্যদের দাবিÑ আন্দোলন থেকে ফেরার পথে তাদেরকে কেউ ধরে নিয়ে রুমে আটকে রেখেছিল, নতুবা পুড়ে যাওয়া কক্ষের বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল কেন?
লালমনিরহাট ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদার রহমান বলেন, রাত ২টার দিকে আমরা পুড়ে যাওয়া সুমন খানের বাসায় যাই। পুরো বাড়ি ভালোভাবে খোঁজার পর ছয়টি পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি লাশ ছিল ঘরের মধ্যে ও ওয়াশরুমে। পরবর্তী সময়ে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় শিক্ষার্থীর পুড়ে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা কেউই বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। তারাও জানতে চান কেমন করে তারা ওই বাড়িতে গিয়ে পুড়ে মারা গেল। পুলিশের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত কোনো মামলা না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কারো কাছ থেকেও তেমন কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
নিহত রাজিবের বাবা রেজাউল করিম সরকার বলেন, দুপুরে বাসায় আসার পর আবার বিকেল ৪টার দিকে আমার ছেলে বের হয়ে যায়। ৫টার দিকে ফোনে কথা বলেছিলাম। এরপর খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে রাত ১০-১১ পর্যন্ত তার ফোনে কল ঢুকেছিল; কিন্তু কেউ রিসিভ করেনি। সে আগুনে পুড়ে গেলে ফোনও পুড়ে যাওয়ার কথা।

শ্রাবণের বড় জ্যাঠা আব্দুল মজিদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতেই শ্রাবণ বাসা থেকে বের হয়েছিল। রাতে হাসপাতালে গিয়ে পুড়ে যাওয়া লাশ শনাক্ত করি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হামিদুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় ছয় ছাত্রের মৃত্যু রহস্যজনক, কোনো পক্ষ ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য তাদের হত্যা করে থাকতে পারে। তিনি আগুনে পুড়ে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে লালমনিরহাট জেলায় মোট ১২ জন নিহত হয়েছেন, এর মধ্যে শুধু ৫ আগস্ট আগুনে পুড়ে ছয়জন ও পুলিশের গুলিতে বাকি ছয়জনের মৃত্যু হয়।
পুলিশের গুলিতে নিহত ছয়জনকে সরকার শহীদি মর্যাদাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর্থিকভাবে সহযোগিতা করলেও আগুনে পুড়ে যাওয়া এই ছয় শিক্ষার্থী সবকিছু থেকে বঞ্চিত। মর্মস্পর্শী এ ঘটনায় প্রায় পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও গঠিত হয়নি কোনো তদন্ত কমিটি।
লালমনিরহাট জেলা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক ওয়াদুদ হোসেন বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতার ওই বাসার আগুন নেভানোর পর নিহত শিক্ষার্থীদের অঙ্গার দেহ উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
লালমনিরহাট সদর থানার ওসি আব্দুল কাদের বলেন, এ ঘটনায় লালমনিরহাট সদর থানায় চয় আগস্ট জিডি হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কেউ কোনো মামলা করেননি।


আরো সংবাদ



premium cement