২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত

যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন বুলেটবিদ্ধ সুজন

-


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন লক্ষ্মীপুরের কলেজছাত্র খালেদ মাহমুদ সুজন। তার ঘাড়,গলা ও পুরো শরীর জুড়ে এখনো ৮টি বুলেট রয়ে গেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না পরিবার। দেশে তার চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। বিদেশে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে শরীর থেকে গুলিগুলো বের করলেই তার জীবন বাঁচানো সম্ভব। অন্যথায় অকালে মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়তে পারে সুজন।
সদর উপজেলার চররুহিতা এলাকার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হতদরিদ্র শাহীন কাদিরের ছেলে ও উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের এইচএসসি অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ সুজন(১৯)। তার ছোট দুই ভাই সোহান হোসেন ও শিহাব হোসেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সোহান হোসেনও বাবার মতো বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। অপর ভাই শিহাব অষ্টম শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে। মা-বাবাসহ পাঁচজনের সংসার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। পরিবারের পাঁচ সদস্যের আহার এবং নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে খণ্ডকালীন একটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি।

গত ৪ আগস্ট। সরকার পতনের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সারা দেশের মতো লক্ষ্মীপুরও সেøাগানে সেøাগানে উত্তাল। শহরের মাদাম ব্রিজ ও তমিজ মার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সহপাঠীদের সাথে অংশ নেয় কলেজশিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ সুজন। এ সময় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এক পর্যায়ে শহরের নিজ বাসভবনের ছাদ থেকে প্রকাশ্যেই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু হয়। এতে খালেদ মাহমুদ সুজনসহ তিনশ’র বেশি শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় মারা যায় চার শিক্ষার্থী। গুলিবিদ্ধ সুজনকে প্রথমে লক্ষ্মীপুর সদর পরে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করে অপারেশনের মাধ্যমে দুটি গুলি বের করা হয়। এখনো তার ঘাড়-গলা ও ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৮টি গুলি রয়েছে। যেগুলো এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। শরীরে এসব গুলি নিয়ে বাড়িতে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন সুজন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তার পিতা।

সম্প্রতি সরেজমিনে চররুহিতার তাজুল ইসলাম ভূঁইয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ সুজনকে কফিল উদ্দিন ও আজাদ চৌধুরী নামে দুইজন তাদের কাঁধে ভর দিয়ে ঘর থেকে বের করছেন। কোনোভাবেই সুজন দাঁড়াতে পারছেন না। পাশে তার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাবা এবং শাহীন কাদির ও ছোটভাই সোহান দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এ সময় তাদের দুইজনকে চোখের পানি মুছতে দেখা গেছে।
খালেদ মাহমুদ সুজন জানান, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে ডাকা সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। গত ৪ আগস্ট দুপুরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে তাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। এতে তার শরীরে ১০টি বুলেট বিদ্ধ হয়। অপারেশন করে দুটি গুলি বের করলেও ৮টি গুলি এখনো শরীরের ভিতরে রয়েছে।
তিনি বলেন, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। এখনো সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাইনি।
স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে সবার সহযোগিতা চান তিনি। জানান, দ্বিতীয়বারের মতো দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেটাই বড় প্রাপ্তি তার। যতই কষ্ট বা যন্ত্রণা হোক, মনে প্রশান্তি রয়েছে। হাসিনার পতনে সব কষ্ট ভুলে গেছেন।

স্বজন কফিল উদ্দিন ও আজাদ চৌধুরী বলেন, অসহায় এই পরিবারের সদস্যদের এখন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন সুজন। তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি একটি দোকানে খণ্ডকালীন চাকরি করে পরিবারের ও পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছিলেন। এখন কিভাবে সামনের দিনগুলো যাবে, সে চিন্তায় দিশেহারা পরিবার। সামাজের অর্থবিত্তবানরা তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেন স্বজনরা।
পাশাপাশি গুলিবর্ষণকারী সন্ত্রাসী সালাউদ্দিন টিপুসহ জড়িতদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানান তারা। এ ছাড়া সুজনকে দ্রুত বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছেও দাবি জানান আহত শিক্ষার্থীর স্বজনরা।

এ দিকে ঘটনার দিন সদর হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা: মো: জয়নাল আবেদিন বলেন, দেশে খালেদ মাহমুদ সুজনের চিকিৎসা সম্ভব নয়। প্রতিটি গুলি খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায় রয়েছে। গুলির কারণে শরীরে ইনফেকশন দেখা দিলে সুজনের জীবনহানিও ঘটতে পারে।
এ দিকে জেলা পুলিশ সুপার মো: আকতার হোসেন বলেন, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছাত্রদের ওপর হামলাকারীরা ছাড় পাবে না, তাদের ধরতে ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে। অপরাধী যতই বড় বা শক্তিশালী হোক না কেন? ধরা পড়তে হবেই।
জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার বলেন, বৈষম্যবিরোধী হতাহত শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন সব সময় আছে, থাকবে। পাশাপাশি যারা তাদের ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণ করেছে, তাদের কেউই রেহাই পাবে না। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। উদ্ধার করা হবে অবৈধ সব অস্ত্র। এ বিষয়ে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement