১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

শ্রীলঙ্কা : রাজাপাকসে পরিবারের তরুণ নেতা কেন প্রেসিডেন্ট হতে চাচ্ছেন

সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের ছেলে এবং অভুথানে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট গটাবায়া রাজাপাকসের ভাতিজা নামাল রাজাপাকসে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। ফটো : ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ - ছবি : ভয়েস অব আমেরিকা

শ্রীলঙ্কায় যখন এক গণঅভ্যুত্থান প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তখন অনেকে সেটাকে এই দ্বীপ দেশের ওপর তার প্রতাপশালী পরিবারের ১২ বছরের আধিপত্যর অবসান হিসেবে দেখে।

এখন শ্রীলঙ্কা নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং নামাল রাজাপাকসে প্রার্থী হয়েছেন। এই ৩৮ বছর বয়সী হচ্ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের ছেলে এবং অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট গটাবায়া রাজাপাকসের ভাতিজা।

নামাল রাজাপাকসে নিজেকে পরিবর্তনের দূত হিসেবে উপস্থাপন করছেন। কিন্তু অনেকেই তার প্রার্থীতাকে তার বিতর্কিত পরিবারের ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।

এই পরিবারের রাজনৈতিক জীবন ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়েই বিধ্বস্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের বাড়ি-ঘরে হামলা করায়, পরিবারের কিছু সদস্য সেনা বাহিনীর ঘাঁটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যরা সরকারে তাদের পদ ছেড়ে দেন। দুই কোটি মানুষের দেশকে অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিক্ষেপ করার জন্য জনগণ তাদেরকে দোষারোপ করে।

দুই বছর পর এই পরিবার রাজাপাকসের উত্তরাধিকারীর মাধ্যমে আবার রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করছে। নামাল রাজাপাকসে নিজেকে উপস্থাপন করছেন এমনভাবে যে, তিনি শ্রীলঙ্কার জন্য সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ এনে দিবেন।

নামাল রাজাপাকসের সিদ্ধান্ত
তবে নামাল রাজাপাকসের জন্য, এটা শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, এটা গভীরভাবে ব্যক্তিগত। রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ যে তারা দেশকে তাদের পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে পরিচালনা করে ২০২২ সালে অর্থনীতিতে ধস নামান, ওই অভিযোগ তিনি খণ্ডন করতে চান। একইসাথে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করার রায়ও খারিজ করতে চান।

দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে সম্প্রতি নামাল বলেন ‘আমার বা আমার পরিবারের জন্য দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণ বিষয় না। আপনি যদি এই দেশের সকল রাজনিতিকের দিকে তাকান বা আমাদের অঞ্চলসহ সারা বিশ্বে... তাদের সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে। মানুষ বুঝতে পারবে, কারণ আপনি যদি বর্তমান সময়ের দিকে তাকান, সবাই একে অপরকে দোষারোপ করছে।’

শ্রীলঙ্কা এক সময় দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিক আশার জায়গা ছিল। কিন্তু ঋণের বোঝা এবং কোভিড-১৯ মহামারির ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মারাত্মক অভাব দেখা দেয় এবং ২০২২ সালে দেশটি অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত হয়। সঙ্কট একটি গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয় এবং বিক্ষুব্ধ মানুষ প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতর আর অন্যান্য সরকারি ভবন দখল করে নেয়। গটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং পরে পদত্যাগ করেন। সংসদে রাজাপাকসে পরিবারের তখনো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল এবং প্রেসিডেন্টের মেয়াদের বাকিটুকু সময় দায়িত্ব পালনের জন্য রানিল ভিক্রেমাসিঙ্ঘেকে নির্বাচিত করা হয়। ভিক্রেমাসিঙ্ঘে সংসদে আইন পাস করার জন্য তাদের সমর্থনের বিনিময়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এর ফলে রাজনীতিতে এই পরিবারের প্রত্যাবর্তন সম্ভব হচ্ছে।

নামাল বলেন, ‘আমারা পালিয়ে যাইনি, আমরা কখনো পালাই নাই। কিছু লোক মনে করেছিল আমরা লুকিয়ে আছি।’

দলের ওপর রাজাপাকসেদের মালিকানা
জয়ের জন্য নামালের সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ মনে হচ্ছে, কারণ প্রতিযোগিতা হবে মূলত অন্য তিন প্রার্থীর মধ্যে ভিক্রেমাসিঙ্ঘে, সংসদে বিরোধী দলের নেতা এবং একজন বামপন্থি নেতা যার শক্তিশালী জোট আছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের শ্রীলঙ্কা বিষয়ক সিনিয়র কন্সাল্টান্ট অ্যালান কিনান বলছেন, প্রেসিডেন্টে পদের জন্য তরুণ রাজাপাকসের প্রার্থিতা হচ্ছে একটি পরীক্ষামূলক প্রচারণা, যেটা পরিবারের ‘উত্তরাধিকারী হিসেবে তার অবস্থান’ পাকাপোক্ত করবে।

কিনান বলেন, ‘আমার মনে হয় তারা (রাজাপাকসেরা) জানে নামাল জিতবে না। কিন্তু তার প্রার্থিতা দলের ওপর পরিবারের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।’

কয়েক দশক ধরে রাজাপাকসে পরিবার শ্রীলঙ্কার রাজনীতির একটি স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তারা প্রায় সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলে আমলাতন্ত্র থেকে আদালত, পুলিশ, ব্যবসা এবং ক্রীড়াঙ্গন।

নামাল রাজাপাকসের বাবা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তার পর ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ২৬ বছরের রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে পরাজিত করার জন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সিনহালা জনগোষ্ঠীর কাছে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে ২০১৫ সালে তিনি পরাজিত হন।

মাহিন্দা আর গটাবায়া
কিন্তু চার বছর পর পরিবার আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে, যখন মাহিন্দার ভাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। গটাবায়া রাজাপাকসে ২০১৯ সালে ইস্টার রোববারে বোমা হামলার জন্য ইসলামিক উগ্রবাদীদের দায়ী করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সিনহালা জনগোষ্ঠীকে উত্তেজিত করে তোলেন। বোমা হামলায় ২৯০ জন নিহত হয়। কিন্তু অর্থনীতির পতন আর তামিল, মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার হওয়ায় পরিবারের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমতে থাকে।

নামাল রাজাপাকসে একজন তরুণ, আধুনিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে চান, পরিবারের কলুষিত অতীত থেকে নিজেকে দূরে রেখে। তার প্রচেষ্টায় তার বাবার কাজ প্রতিফলিত হচ্ছে। মাহিন্দা রাজাপাকসে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার জন্য এখনো কিছু ভোটারদের মাঝে জনপ্রিয়। তার বাবার মতো, নামাল রাজাপাকসে বৌদ্ধ সিনহালা সংস্কৃতি তুলে ধরে পোশাক পরেন ঘারে একটি খয়েরি রঙের স্কার্ফ, সাদা সারোং আর জামা। প্রচারণার সময় তাকে তার বাবর পা স্পর্শ করতে দেখা যায় যে প্রথা স্থানীয়রা শ্রদ্ধা করে।

তিনি দেশকে ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা ডিজিটাল করে দুর্নীতি নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

দুর্নীতি আর দেউলিয়াপনা
তারপরও, শ্রীলঙ্কার অনেকেই এই পরিবারের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইছে না। রাজাপাকসের প্রার্থিতার বিরুদ্ধে জনমত সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে তামিল সম্প্রদায়ের মাঝে, যারা দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ।

মাহিন্দা এবং গটাবায়া রাজাপাকসের নেতৃত্বে সরকারি বাহিনী ২০০৯ সালে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগার্স গোষ্ঠীকে ধ্বংস করে। শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ ১৯৮৩ সালে শুরু হয় এবং দুই পক্ষে কমপক্ষে এক লাখ লোক মারা যায় এবং আরো অনেকে নিখোঁজ হয়।

যদিও সকল তামিল জনগণ বিদ্রোহী টাইগার্সদের পক্ষে ছিল না, তাদের পরাজয় কার্যত পুরো তামিল সম্প্রদায়ের জন্য একটি রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তারা গৃহযুদ্ধের সময় বেসামরিক মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন করার অভিযোগও আনে রাজাপাকসেদের বিরুদ্ধে।

‘রাজকুমার আর ক্রীতদাস’
ভেলাইয়ান সিয়াপ্রাকাশ একজন তামিল যিনি মধ্য শ্রীলঙ্কায় অডিটর হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলছেন, রাজাপাকসের শাসনামলে তিনি সব সময় সহিংসতার ভয়ে থাকতেন। তিনি শ্রীলঙ্কায় আর বসবাস করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তার সন্দেহ হতো।

সিয়াপ্রাকাশ বলেন, ‘তাদের শাসন ছিল রাজতন্ত্রের মতো, তারা রাজকুমারের মতো ব্যবহার করতো আর আমাদেরকে দেখত ক্রীতদাস হিসেবে। তাদের কখনো ক্ষমতায় ফিরে আসা উচিত না।’

রাজাপাকসেদের এখনো বড় সমর্থন আছে, যারা যুদ্ধ শেষ করতে এবং রাস্তা-ঘাট, বিমান বন্দর এবং চীনা ঋণে নৌ-বন্দরসহ বড় অবকাঠামো তৈরি করতে তাদের ভূমিকার প্রশংসা করে।

তাদের অনেকে যদিও মনে করে যে, নামাল রাজাপাকসের জেতার কোনো সুযোগ নেই, তারা তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী।

আর এম লাসান্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে পাইপ ফিটার হিসেবে কাজ করেন তিনি বলেন, ‘আমি নামালের জন্য ভোট দেবো কারণ, আমি তার বাবার সরকারের আমলে আমার চাকরি পেয়েছি। নামাল এখনো তরুণ এবং একদিন তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন।’

কোনো কোনো শ্রীলঙ্কান মনে করেন রাজাপাকসেদের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করতে কমপক্ষে এক দশক লাগবে।

মানিলাল রানাসিঙ্ঘে পর্যটন শিল্পে কাজ করেন তিনি বলেন, ‘তাদের নাম দুর্নীতি আর দেউলিয়াপনার সাথে জড়িয়ে আছে, কাজেই তাদের ভাবমূর্তি পুনরায় গড়ে তোলা হবে বড় এক চ্যালেঞ্জ।’

একইসাথে রানাসিঙ্ঘে বলেন, ‘আমরা জানি শ্রীলঙ্কান্দের স্মরণশক্তি খুবই কম।’

সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা


আরো সংবাদ



premium cement
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজায় আসলে কী হয়েছিল? মেয়াদবিহীন ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু করুন : তথ্য উপদেষ্টা বহিরাগতমুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে ঢাবিতে নামবে ‘মোবাইল কোর্ট’ পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়ন প্রচেষ্টায় নজর ভারতের এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে রিট নাটোরে গৃহবধূকে গণধর্ষণের অভিযোগে যুবদল নেতাসহ গ্রেফতার ৬ বহিরাগতমুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে ঢাবিতে নামবে ‘মোবাইল কোর্ট’ ভিসা সমস্যার সমাধানে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা মার্চেন্ট শিপিং ফেডারেশনের শহীদ পরিবার পাচ্ছে ৫ লাখ, আহতরা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা রাজশাহীতে শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হলেন অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম

সকল