‘লাজুক’ স্বভাবের ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ যেভাবে শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৮ মে ২০২৪, ১০:২৩, আপডেট: ১৮ মে ২০২৪, ১০:২৭
স্বজাতির কাছে তিনি ছিলেন ‘স্বাধীনতাকামী’ নেতা। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সরকার তাকে চিহ্নিত করেছিল একজন ‘ক্ষমতালোভী’ মানুষ হিসেবে, যিনি দেশটিকে ভেঙে দুই টুকরো করে ফেলতে চান। তাকে নিয়ে লোকমুখে গল্প প্রচলিত ছিল যে, তিনি নির্দেশ দিলে হাজার হাজার সমর্থক তার জন্য নিজেদের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করতো না।
সম্ভবত সেকারণেই তিনি ‘লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম’ (এলটিটিই) নামের একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেই বাহিনীকে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
জাতীয়তাবাদী তামিল জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে তার অবস্থান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মৃত্যুর দেড় দশক পরেও অনেকে বিশ্বাস করেন, তিনি বেঁচে আছেন এবং যথাসময়ে আবারো তাদের মাঝে ফিরে আসবেন।
যে ব্যক্তিকে নিয়ে এত আলোচনা, তার নাম ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ।
তিনি ছিলেন শ্রীলঙ্কার তামিল জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের সশস্ত্র সংগঠন এলটিটিই’র প্রতিষ্ঠাতা এবং শীর্ষ নেতা।
তামিলদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তিনি এই সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। যদিও শেষপর্যন্ত তার সেই লক্ষ্যপূরণ হয়নি।
আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে, অর্থাৎ ২০০৯ সালের ১৮ মে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী ঘোষণা করেছিল যে, এক সামরিক অভিযানে প্রভাকরণের মৃত্যু হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়েই দেশটিতে আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল।
পরিচিতজনদের কাছে প্রভাকরণ ছিলেন লাজুক প্রকৃতির একজন বইপ্রেমী মানুষ।
কিন্তু কোন ঘটনায়, কিভাবে সেই লাজুক ব্যক্তিটি বিশ্বের অন্যতম বড় সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা হয়ে উঠেছিলেন?
কেমন ছিল প্রথমদিকের জীবন?
ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশের রাজধানী জাফনার উত্তর দিকে অবস্থিত ভেলভেত্তিয়াথুরাই শহরে ১৯৫৪ সালের ২৬ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
ছোটবেলা থেকেই প্রভাকরণ বেশ লাজুক প্রকৃতির ছিলেন বলে জানা যায়। স্কুলে থাকতেই তিনি পাঠ্যক্রমের বাইরে বিভিন্ন ধরনের বইপড়া শুরু করেন।
এরপর ক্রমেই বড় হন, ততই বইয়ের প্রতি তার আসক্তি বাড়তে থাকে বলে পরিচিতজনরা বলে থাকেন।
প্রভাকরণ তার জীবদ্দশায় গণমাধ্যমকে হাতে গোনা কয়েকটি একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
সেসব সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা সুভাষ চন্দ্র বসু এবং ভগত সিং যৌবনে তাকে বেশ প্রভাবত করেছিল।
এছাড়া গ্রিক বীর আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট এবং ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টের জীবনী পড়েও তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন বলে জানান।
প্রভাকরণ এটাও জানিয়েছিলেন যে যৌবনের ওই সময়টাতে শ্রীলঙ্কায় বসবাসরত তামিলদের প্রতি দেশটির সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী সিংহলিদের বৈষম্যমূলক আচরণ দেখে তার মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
ফলে বৈষম্যের প্রতিবাদে তখন তিনি ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিক্ষোভ-আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করেন।
এক পর্যায়ে প্রভাকরণ অনুধাবণ করেন যে তামিলদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রয়োজন।
মূলত তখনই জাতীয়তাবাদী তামিল সমর্থকদের নিয়ে একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা তার মাথায় আসে বলে জানা যায়।
এলটিটিই'র সৃষ্টি যেভাবে
তামিলদের অধিকার আদায়ে সাংগঠনিকভাবে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা থেকে প্রভাকরণ ‘তামিল নিউ টাইগারস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গড়ে ওঠা ওই সংগঠনটি শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠী, বিশেষত প্রান্তিকশ্রেণির তামিলদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।
এরপর ১৯৭৫ সালে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের বিরুদ্ধে জাফনার তৎকালীন মেয়রকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনার বছরখানেক পর ১৯৭৬ সালের ৫ মে ‘তামিল নিউ টাইগারসে’র নাম পরিবর্তন করে ‘লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম’ (এলটিটিই) রাখেন প্রভাকরণ।
সংগঠনটি সংক্ষেপে ‘তামিল টাইগার্স’ নামেও পরিচিতি পায়।
কিছুদিনের মধ্যেই সংগঠনটি ১০ হাজারেরও বেশি সদস্যের একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে।
এলটিটিই গঠনের উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলঙ্কায় বসবাসরত তামিল জনগোষ্ঠীর জন্য দেশটির উত্তর আর পূর্বাঞ্চল নিয়ে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা।
অর্থ সংগ্রহ এবং বর্হিবিশ্বে নিজেদের দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিকপর্যায়ে একটি নেটওয়ার্কও গড়ে তুলতে সক্ষম হন প্রভাকরণ।
ধীরে ধীরে এলটিটিই’র সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে।
সন্ত্রাসী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী সংগঠন সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল (এসএটিপি) বলছে, এলটিটিই একমাত্র সশস্ত্র সংগঠন যারা সামরিক বাহিনীর তিনটি বিভাগই গড়ে তুলেছিল।
সেগুলো যথাক্রমে ল্যান্ড টাইগার্স, সি টাইগার্স এবং এয়ার টাইগার্স নামে পরিচিত ছিল।
ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বসবাসরত তামিল জনগোষ্ঠীর লোকেরা এক্ষেত্রে এলটিটিই-কে অর্থ সহায়তা দিয়েছিল বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়।
এলটিটিই বাহিনীতে নারী ও শিশুদেরও নিয়োগ করতো বলেও জানিয়েছে এসএটিপি।
শ্রীলঙ্কার সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল সারাথ ফনসেকাকে উদ্ধৃত করে এএটিপি লিখেছে যে, ২০০৮ সালে এলটিটিইতে ১৮ হাজারেরও বেশি সদস্য ছিল।
গৃহযুদ্ধ শুরু
এলটিটিই চেয়েছিল শ্রীলঙ্কার উত্তর পূর্বে একটা স্বাধীন রাজ্য গঠন করতে।
সেই লক্ষ্যে তারা ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে শ্রীলঙ্কার সরকারের বিরুদ্ধে পুরোদমে গেরিলা হামলা শুরু করে।
এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির সরকারি বাহিনীও পাল্টা হামলা করতে থাকে।
শুরু হয় শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।
প্রভাকরণ এবং তার বাহিনী মূলত গেরিলা আক্রমণের জন্যই সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিল।
দলের সদস্যদের তিনি বোঝাতেন যে স্বজাতির মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করাই সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগ।
আর এভাবেই পরবর্তীতে এলটিটিই’র সদস্যরা ধীরে ধীরে একের পর এক আত্মঘাতী হামলা চালানো শুরু করে দেয়।
হামলা চালানোর ক্ষেত্রে তারা প্রধানত জনাকীর্ণ স্থানকেই বেছে নিত। ফলে এতে বেসামরিক লোকজনই বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতো।
১৯৯৬ সালে এলটিটিই’র সদস্যরা কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গেটে একটি বড় বিস্ফোরণ ঘটায়।
সেই বিস্ফোরণে ৯০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং আরো প্রায় দেড় হাজার জন আহত হয়।
হতাহতদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক।
সশস্ত্র গোষ্ঠীটির চালানো হামলায় বেশ কয়েকজন বিদেশী নাগরিক মারা যাওয়ার খবরও অতীতে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।
এসব হামলার ঘটনার পর প্রভাকরণকে গ্রেফতার করতে তৎপর হয়ে উঠে শ্রীলঙ্কার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
যদিও বছরের পর বছর ধরে তিনি ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গিয়েছিলেন।
প্রভাকরণ সবসময় নিজের কাছে বিষ রাখতেন, যাতে শ্রীলঙ্কার সরকারি বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেই সেটি খেয়ে আত্মহত্যা করতে পারেন।
পরবর্তীতে তার দলের অন্য সদস্যরাও এই কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেন বলে জানা যায়।
রাজীব গান্ধীকে হত্যা
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যার জন্য এলটিটিই’র প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে দায়ী করা হয়।
১৯৯১ সালে চেন্নাইয়ের কাছে একটি আত্মঘাতী হামলায় গান্ধী নিহত হন।
গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে শ্রীলঙ্কার সরকারি বাহিনীর সাথে এলটিটিই’র সদস্যদের যুদ্ধ চলছিল।
তখন গান্ধীর সরকার শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সেনা পাঠান।
বলা হয়ে থাকে যে এ ঘটনায় প্রভাকরণ বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং প্রতিশোধ হিসেবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যার নির্দেশ দেন।
যদিও প্রভাকরণ নিজে কখনো রাজীব গান্ধীকে হত্যা করার বিষয়টি স্বীকার করেননি।
এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে গান্ধীর মৃত্যুর ঘটনাকে তিনি কেবল ‘মর্মান্তিক ঘটনা’ বলেই থেমে গেছেন।
আত্মঘাতী হামলায় গান্ধী মারা যাওয়ার পর ভারতের একটি আদালত প্রভাকরণের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
এছাড়া মানুষ হত্যা করা এবং সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর অভিযোগে নিজেদের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল।
যদিও এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রভাকরণকে সেভাবে থামানো যায়নি।
উত্তরাঞ্চল দখল
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যা করার দুই বছরের মাথায় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসাকে হত্যা করেন এলটিটিই’র সদস্যরা।
১৯৯৩ সালে প্রেমাদাসা কলম্বোয় আয়োজিত শ্রমিক দিবসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলার শিকার হন।
এর তিন বছর পর কলম্বোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে বড় ধরনের বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যাতে বহু মানুষ মারা যান।
একের পর এক হামলা চালিয়ে ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামারসহ বেশ কয়েকজন মেয়র, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে তামিল টাইগার্স।
আর এভাবেই দেশটির উত্তরাঞ্চলের বড় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রিত নিতে সক্ষম হন প্রভাকরণ।
নব্বই দশকের শেষনাগাদ এলটিটিই’র সদস্যরা শ্রীলঙ্কার এক তৃতীয়াংশ এলাকা দখল করে নেয়।
যে ঘটনায় পরিস্থিতি বদলে যায়
২০০৬ সালে কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোটাভায়া রাজাপাকশাকে টার্গেট করে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়।
হামলার জন্য শ্রীলঙ্কা সরকার তামিল টাইগার্সকে দায়ী করে।
রাজাপাকশা ছিলেন শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকশার ছোটভাই।
এছাড়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ায় তার মাধ্যমেই দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে সরকারের যোগাযোগ হতো।
সবমিলিয়ে রাজাপাকশা এলটিটিই’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটে পরিণত হন।
যদিও হামলায় রাজাপাকশা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান এবং পরবর্তীতে তিনিও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের আসনে বসেন।
শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক সামান্থা পেরেরা তার সাংবাদিক জীবনের বেশিরভাগটাই তামিল টাইগারদের সাথে সরকারের সঙ্ঘাত নিয়ে খবর করেছেন, যেসব শ্রীলঙ্কায় নিহত হয়েছিল প্রায় এক লাখ মানুষ।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ২০০৬ সালে গোটাভায়া রাজাপাকশাকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানোর আট মাস আগে দেশটির তৎকালীন সেনাপ্রধান সারাথ ফনসেকাকে টার্গেট করেও একই ধরনের হামলা চালানো হয়।
তখন হামলা হয়েছিল সেনাবাহিনীর সদর দফতরের ভেতরে। তবে ফনসেকাও তখন প্রাণে বেঁচে যান।
এসব ঘটনার পর শ্রীলঙ্কার জনগণের মধ্যে এমন একটা ধারণাটা তৈরি হয়েছিল যে সরকার হয় তামিল টাইগারদের সাথে আলোচনা আবার শুরু করতে হয় অনাগ্রহী, নয়তো হাল ছেড়ে দিয়েছে।
ফলে রাজাপাকশা সরকার তখন এলটিটিই'র বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এতে সামরিক সংঘাত বহুগুণ বেড়ে যায় এবং চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়
আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়
গোটাভায়া রাজাপাকশার ওপর ওই হামলার ঘটনা শ্রীলঙ্কার পরবর্তী ইতিহাস বদলে দিয়েছিল বলে ধারণা করেন অনেকে।
সেসময় নানান কারণে রাজাপাকশা পরিবার বেশ কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। এমনকি দেশটির সাধারণ জনগণও তাদের বিরুদ্ধ অবস্থান নিতে শুরু করেছিল বলে জানা যায়। কিন্তু হামলার ঘটনার পর রাজাপাকশাদের প্রতি শ্রীলঙ্কার জনগণের এক ধরনের সহমর্মিতা তৈরি হয়।
আর সেজন্যই সমালোচকদের অনেকে বলেন, রাজাপাকশা দুই ভাই এই হামলাকে ব্যবহার করেছিলেন নিজেদের শক্তিশালী ভাবমূর্তি তৈরি করতে।
কঠোর অবস্থানে রাজাপাকশা সরকার
২০০০ সালের শুরুর দিকে এলটিটিইর সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করেছিল শ্রীলঙ্কার সরকার। কিন্তু রাজাপাকশা পরিবারের ওপর হামলার পর সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।
এরপর ২০০৭ সালে নরওয়ের মধ্যস্থতায় পুনরায় শান্তি আলোচনা শুরু হলেও, সেটি বেশিদূর এগোয়নি।
সাংবাদিক সামান্থা পেরেরা বিবিসিকে বলেন যে ২০০৬ সালের হামলার ঘটনার পর রাজাপাকশা ভাইরা তখন স্পষ্ট করে দেন যে ‘শান্তি আলোচনার সব সুযোগ শেষ’।
‘গোটাভায়া রাজাপাকশা ছিলেন সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যে প্রধান যোগসূত্র,’ বলছিলেন মি. পেরেরা।
“আর সরকার প্রধান ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকশা। দু'জনেই তখন টাইগারদের বিরুদ্ধে একটা কট্টর অবস্থান নিয়েছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন পেরেরা।
বস্তুত তখন থেকেই এলটিটিইর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন সরকার।
বিদেশেও কোণঠাসা এলটিটিই
আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোসহ নিজেদের নানান কর্মকাণ্ডের কারণে শ্রীলঙ্কা ছাড়াও বর্হিবিশ্বেও বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েন প্রভাকরণ।
এলটিটিই'র তহবিলেরএকটি বড় অংশই সংগ্রহ করা হতো বিদেশে বসবাসরত তামিল জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে।
রাজীব গান্ধীকে হত্যাসহ নানান ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশ্বের অনেক দেশ প্রভাকরণের সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে শুরু করে।
সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ওপরে নজর রাখে এমন একটি সংগঠন সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল (এসএটিপি) বলছে, ‘এলটিটিইকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করে।’
‘যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই ২০০৮ সালে তাদের এক রিপোর্টে এলটিটিই কে বিশ্বের সবথেকে বিপজ্জনক ও মারাত্মক উগ্রপন্থী সংগঠন বলে ব্যাখ্যা করেছিল,’ লিখেছে এসএটিপি।
এছাড়া ইউনিসেফ ও হিউমান রাইটস ওয়াচ তাদের রিপোর্টে একাধিকবার এলটিটিইর বিরুদ্ধে শিশুদের বলপূর্বক নিয়োগের অভিযোগ তুলে ধরেছে।
সবমিলিয়ে প্রভাকরণ বেশ সঙ্কটের মধ্যে পড়ে যান।
মৃত্যুতে গৃহযুদ্ধের অবসান
শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে তামিলদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন প্রভাকরণ। ফলে জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় তাকে কাটাতে হয়েছে বনে-জঙ্গলে গোপন আস্তানায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণ হয়নি।
লোকমুখে প্রচলিত আছে যে এলটিটিই’র এই নেতা একবার না কি তার বাহিনীর সদস্যদের বলেছিলেন যে জীবনে কখনো যদি তিনি নীতি পরিবর্তন করেন, তখন যেন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
যদিও বাস্তবে তার মৃত্যু হয়েছিল শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর হাতে।
শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই প্রভাকরণ এবং তার বাহিনীর ওপর জোরালোভাবে হামলা চালাতে শুরু করে শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী।
জল, স্থল এবং আকাশপথ- তিন দিক দিয়েই সমানতালে চলতে থাকে আক্রমণ।
সরকারি বাহিনীর একের পর এক আক্রমণের মুখে দখলকৃত এলাকাগুলো থেকে ক্রমেই পিছু হটতে থাকে তামিল টাইগার্স সদস্যরা।
২০০৯ সালের শুরুর দিকে শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলে এলটিটিই’র মূলঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কিলিনোচ্ছি দখল করে নেয় দেশটির সরকারি বাহিনী।
এ ঘটনায় প্রভাকরণের বাহিনী আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।
কিলিনোচ্ছি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর সরকারি বাহিনীর সমন্বিত হামলার মুখে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রভাকরণ নিহত হন।
দেশটির তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সারাথ ফোনসেকা ২০০৯ সালের ১৮ মে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রভাকরণের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন।
তার এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। এতে কমপক্ষে এক লাখ নিহত এবং প্রায় তিন লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। এছাড়া হাজার হাজার মানুষ শ্রীলঙ্কা ছেড়ে অন্যদেশে পালিয়ে গিয়েছিল।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশটির সংখ্যালঘু তামিলরা। সম্পত্তি ও স্বজন হারানোর পাশাপাশি নারীদের অনেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রভাকরণ কি সত্যিই জীবিত?
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার সময় ইন্টারপোল বলেছিল যে প্রভাকরণ এমন এক ব্যক্তি যিনি যেকোনো মুহূর্তে ছদ্মবেশ ধারণ করতে সক্ষম।
শ্রীলঙ্কার তামিল জাতীয়তাবাদীদের অনেকেরই ধারণা, তাদের নেতা প্রভাকরণ এখনো মারা যাননি, ছদ্মবেশ নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
২০২৩ সালে তামিল নেতা ও লেখক পাঝা নেহুমারানের নেতৃত্বে তামিল জাতীয়তাবাদীদের একটি গোষ্ঠী দাবি করেছে যে প্রভাকরণ জীবিত আছেন।
শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ নিয়ে একটি স্মারক উন্মোচনের সময় সাংবাদিকদের সামনে তারা এমন দাবি উত্থাপন করেছিলেন।
‘আমরা এই সুসংবাদটা দিতে চাই যে তামিল ইলম আন্দোলনের নেতা প্রভাকরণ জীবিত আছেন, নিরাপদে আছেন। তার সম্পর্কে যে গুজব ছড়ানো হয়ে এসেছে, তা এবার শেষ হবে,’ বলেন নেহুমারান।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রভাকরণ খুব তাড়াতাড়ি তামিল মানুষের মুক্তির জন্য তার পরিকল্পনা ঘোষণা করবেন। আমরা চাই সারা দুনিয়ার তামিল জনগণ তার পরিকল্পনার সমর্থনে এগিয়ে আসুন।’
নেহুমারান এটাও দাবি করেন যে তিনি প্রভাকরণের পরিবারের সাথে দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ রেখে আসছেন।
তাদের সম্মতি পাওয়ার পরেই প্রভাকরণের জীবিত থাকার বিষয়টি কথা প্রকাশ্যে এনেছেন বলেও জানান তিনি।
যদিও প্রভাকরণ জীবিত বলে যে দাবি করা হয়েছে, সেটি সত্য নয় বলে মন্তব্য করেছে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি তামিলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার রভি হেরাথ জানান, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের একেবারে শেষ সময়ে প্রভাকরণ মারা গিয়েছিলেন।
তার কথায়, ‘১৮ মে ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধের শেষদিনে প্রভাকরণ মারা যান।’
‘তার মৃত্যুর পরে ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছিল। লাশটি যে প্রভাকরণেরই ছিল, তা নিশ্চিত করা গিয়েছিল। এটা নিয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই।”
‘যে বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে তিনি জীবিত আছেন, তা নিয়ে আমরা মোটেই চিন্তিত নই, কারণ ওই দাবিটাই ভুল,’ বিবিসি তামিলকে বলেন হেরাথ।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা