নাজিব রাজাকের দুর্নীতি : যেভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এশিয়া থেকে হলিউড
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৫ আগস্ট ২০২০, ১১:২৩
কয়েক শ’ কোটি ডলারের অর্থ কেলেঙ্কারিতে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ১২ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত আনা দুর্নীতির সাতটি অভিযোগেই তিনি দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। এই দুর্নীতি বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর অন্যতম, যার জাল জড়িয়ে পড়েছিল এশিয়া থেকে হলিউড পর্যন্ত ।
ওয়ান মালয়েশিয়ান ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ বা ওয়ানএমডিবি একটি রাষ্ট্রীয় তহবিল, যা গঠন করা হয় ২০০৯ সালে যখন নাজিব রাজাক দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে এই প্রকল্প নেয়া হয়েছিল।
মালয়েশিয়ার জনগণকে সাহায্য করার জন্য গঠিত এই তহবিল থেকে কয়েক শ’ কোটি ডলার অর্থ হাওয়া হয়ে যায়, বিশ্ব অর্থনীতির কালো গহ্বরে কোথায় হারিয়ে যায় সেই বিপুল পরিমাণ অর্থ।
আমেরিকান এবং মালয়েশীয় কৌঁসুলিরা বলেছেন, এই অর্থ কিছু ক্ষমতাশালী ব্যক্তির পকেটে গেছে। এছাড়াও তা দিয়ে কেনা হয়েছে বিলাসবহুল ভবন, ব্যক্তিগত জেট বিমান, ভ্যান গগ এবং মনে-র মতো বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্ম এবং নির্মাণ করা হয়েছে হলিউডের ব্লকবাস্টার হিট ছবি।
কৌঁসুলিরা জানিয়েছেন, তহবিল থেকে সরানো হয়েছে সাড়ে চার শ’ কোটি ডলার, যা গেছে বিভিন্ন ব্যক্তির পকেটে।
এই ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে আছে অন্তত ছয়টি দেশ। বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেনের সন্ধানে তদন্ত চালানো হয়েছে সুইস ব্যাংক থেকে শুরু করে যেসব বিভিন্ন দ্বীপরাষ্ট্র কর মওকুফের স্বর্গরাজ্য সেসব দ্বীপের ব্যাংকগুলোতে এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মূল কেন্দ্রে।
এই কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে থাকা চরিত্র এবং গল্পের প্লট ধারাবাহিক রোমহর্ষক কাহিনির মতো মুখরোচক।
আন্তর্জাতিক পরিসরে যেসব ক্ষমতাশালী এই অর্থে লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ, তাদের কাছে কীভাবে এই অর্থ পৌঁছল তার ওপর ধৈর্য্য ধরে নজর রেখেছিলেন যেসব সাংবাদিক - তাদের রিপোর্টে উঠে এসেছে এই রোমাঞ্চকর গল্প।
নাজিব রাজাক
গল্পের মূল নায়ক মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ২০০৯ সালে ‘দৃঢ় ও সাহসী’ পদক্ষেপ নিয়ে তিনি একটি রাষ্ট্রীয় তহবিল গঠন করেছিলেন।
একসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এই ব্যক্তির ওই সাহসী পদক্ষেপই ৯ বছর পর তাকে কালিমালিপ্ত করে এবং তার রাজনৈতিক পতনের কারণ হয়।
নাজিব রাজাককে বুঝতে হলে তার শিকড়ের দিকে আগে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। তিনি মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী আবদুল রাজাকের বড় ছেলে এবং দেশটির তৃতীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাইপো।
রাজনৈতিক পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। ২০০৯ সালে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন, এবং মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে ৫০ বছরের ওপর আধিপত্য করা দলের প্রধানের দায়িত্ব নন, তখন কেউই বিস্মিত হয়নি। বরং সবাই জানত রাজনৈতিক বংশ পরম্পরায় এটাই ছিল তার ভবিতব্য।
নাজিব তার মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষা শেষ করেন যুক্তরাজ্যের নামকরা বেসরকারি স্কুল মালর্ভান কলেজে। এরপর তিনি ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পখাতের অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন।
ইসলামের ‘মধ্যপন্থা’কে গুরুত্ব দিয়ে তার কথাবার্তার কারণে তিনি ডেভিড ক্যামেরন এবং বারাক ওবামার মতো পশ্চিমা নেতাদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন।
জুলাইয়ের ২৮ তারিখে ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রথম সাতটি দুর্নীতির মামলায় ক্ষমতা অপব্যবহারের দায়ে তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এবং অর্থ সাদা করা ও বিশ্বাস ভঙের দায়ে ছয়টি মামলার প্রত্যেকটির জন্য ১০ বছর করে তাকে জেল দেয়া হয়।
সবগুলো কারাদণ্ডাদেশ একসাথে প্রযোজ্য হবে, তবে আপিল না করা পর্যন্ত এসব সাজা খাটা স্থগিত রাখা হচ্ছে।
‘সব সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে,’ কুয়ালালামপুর হাইকোর্টে বলেছেন বিচারক মোহামেদ নাজলান মোহামেদ ঘাজালি।
রায়ের পর নাজিব সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি অবশ্যই রায়ে সন্তুষ্ট নই।’
‘এটাই চূড়ান্ত রায় নয়, আপিল প্রক্রিয়ার পথ রয়েছে এবং আমাদের আশা আপিলে আমরা সফল হব,’ তিনি বলেন।
রোসমা মনসুর
নাজিব রাজাকের স্ত্রী রোসমা মনসুরের খরচের অভ্যাসকে তুলনা করা হয় ফিলিপিন্সের ইমেলডা মার্কোস আর ফ্রান্সের রানি মারি আন্তোনেতের সাথে।
তার স্বামী ক্ষমতা হারানোর পর ৬৭ বছর বয়স্ক রোসমা মনসুরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং ও কর ফাঁকি দেবার জন্য আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়। তিনি অবশ্য নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।
মালয়েশিয়ায় তার বিলাসবহুল জীবন নিয়ে ঠাট্টামস্করা করা হয়। সাধারণ মানুষকে যে দুমুঠো খাবারের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় সে বিষয়ে তার কোনো ধারণাই নেই বলে কড়া সমালোচনা আছে।
২০১৮ সালে তার ও তার স্বামীর নামে কিছু ভবনে পুলিশের অভিযান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরাট আলোড়ন ফেলে। তখন এরকম ছবি দেখা যায় যে সুপারমার্কেটে বাজার করার ট্রলি ভর্তি হয়ে আছে ৫০০টি দামী হাতব্যাগ, শত শত ঘড়ি আর ২৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার মূল্যের ১২ হাজার বিভিন্ন রকম গহনায়। এসব ছবি দেখে মালয়েশিয়ার মানুষের মনে আর সন্দেহ থাকে না যে নাজিব রাজাক পরিবার চরম বিলাসী জীবনযাপন করছে।
‘তিনি অভদ্র নন, কিন্তু বন্ধুসুলভ বা মিশুকও নন। মানুষ হিসাবে তিনি দাম্ভিক, উদ্ধত,’ বলেছেন মালয়েশিয়ায় রয়টার্স বার্তা সংস্থার সাংবাদিক রোজানা লতিফ। ‘যেসব দিন রোসমাকে জেরার জন্য ডাকা হতো, সেসব দিন তিনি কী পরে আসছেন, কোন হাতব্যাগ নিয়ে আসছেন,’ এসব জল্পনা থাকত তুঙ্গে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার পুলিশ রোসমা মনসুর আর নাজিব রাজাককে ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে পুলিশের জব্দ করা শত শত হ্যান্ডব্যাগ, ঘড়ি, ঘড়ির অনুষঙ্গ এবং চশমা সশরীরে পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়।
এইসব জিনিস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, কারণ ওয়ানএমডিবি দুর্নীতির সাথে জড়িত অবৈধ অর্থ দিয়ে বা অসৎ উপায়ে এসব জিনিসের মালিক তারা হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
তাদের আইনজীবী অনুরোধ জানানোর পর মালয়েশিয়ার হাইকোর্ট এসব জিনিস তাদের দেখার অনুমতি দেয়।
কিন্তু তারা এখন যুক্তি দেখাচ্ছেন, যে মোড়কের বা বাক্সের ভেতরে জিনিসগুলো ছিল সেগুলো খুলে ফেলার কারণে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে এবং এর ফলে এগুলো কীভাবে তারা পেয়েছিলেন সেটা প্রমাণ করা তাদের জন্য কঠিন এবং সেটা বিশ্বাসযোগ্য করাও এখন শক্ত হবে।
তারা এমন কথাও বলছেন এসব জিনিস মূল প্যাকেট বা বাক্স থেকে বের করে ফেলায় সেগুলো এখন নষ্টও হয়ে যেতে পারে।
ঝো লো
কর্মব্যস্ত দ্বীপ পেনাং-এর বাসিন্দা চীনা বংশোদ্ভুত মালয়েশীয় অর্থব্যবসায়ী লো তায়েক ঝো সকলের কাছে বেশি পরিচিত ঝো লো নামে। মালয়েশিয়ান এবং আমেরিকান তদন্তকারীরা বলেছেন এই দুর্নীতি কেলেঙ্কারির মূল হোতা তিনিই।
এই রাষ্ট্রীয় তহবিল সংশ্লিষ্ট কোনো পদে তিনি কখনোই ছিলেন না। কিন্তু এর কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ।
এই দুর্নীতি নিয়ে ২০১৮ সালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই ‘বিলিয়ন ডলার হোয়েল’-এর লেখক সাংবাদিক ব্র্যাডলি হোপ আর টম রাইট বলেছেন, ঝো লো ছিলেন ঝানু ব্যবসায়ী আর তার পরিচিত বিশিষ্ট মানুষের গণ্ডিটা ছিল বিশাল। এ বইয়ে তারা লিখেছেন, সে কারণেই তিনি এই দুর্নীতির জাল এতটা ছড়াতে সফল হয়েছিলেন।
‘ঝো লো এই ওয়ানএমডিবি ঘটনার সবচেয়ে বড় ওস্তাদ, সব নাটের রহস্যময় গুরু,’ বিবিসিকে বলেছেন হোপ। ‘গোড়া থেকে এটা স্পষ্ট ছিল যে, এই তহবিলের সাথে জড়িত প্রত্যেকের মাঝে যোগাযোগের সূত্র হলেন ঝো লো এবং এই গোটা কয়েক বিলিয়ন ডলার প্রকল্পের সমস্ত খুঁটিনাটি একমাত্র যে একজন ব্যক্তির নখদর্পণে ছিল তিনি হলেন ঝো লো।’
আমেরিকান কৌঁসুলিরা বলছেন ঝো লো রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে তার যোগাযোগ ব্যবহার করে কোটি কোটি ডলার ঘুষের বিনিময়ে এই ওয়ানএমডিবি প্রকল্পের জন্য ব্যবসা নিয়ে আসতেন।
তারা বলছেন, আমেরিকার অর্থ ব্যবস্থার মাধ্যমে কয়েক শ’ কোটি ডলার ধোলাই করা হয়েছে এবং সেই অর্থ ব্যবহার করে কেনা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দামী কিছু বিলাসবহুল ভবন, বিখ্যাত বহুমূল্য চিত্রকর্ম এবং তৈরি করা হয়েছে হলিউডের বিশাল বাজেটের ছবি।
ব্যবসার সাথে জাঁকজমকপূর্ণ বিনোদনকে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়ানোর জন্য সুপরিচিত ছিলেন ঝো লো। বিশাল অর্থ ব্যয়ে চোখ ধাঁধানো পার্টির আয়োজন, আরব রাজপরিবারের উঁচু মহলের সাথে ঘনিষ্ঠতা আর প্রথম সারির তারকাদের সাথে দহরম-মহরম তাকে দ্রুত সাফল্যের শিখরে উঠতে সাহায্য করেছিল।
২০১২ সালে আমেরিকার লাস ভেগাসে আয়োজিত ঝো লোর এক জন্মদিনের পার্টিতে এমন একটা কেক তৈরি করা হয়েছিল যে কেকের মধ্যে থেকে হঠাৎ আর্বিভূত হয়ে অতিথিদের চমকে দিয়েছিলেন আমেরিকান তারকা ব্রিটনি স্পিয়ারস।
এই দুই সাংবাদিক তাদের বইয়ে এমন আভাসও দিয়েছেন যে, একটা সময়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ নগদ অর্থ ছিল এই ব্যক্তির হাতে।
কিন্তু নাজিব রাজাকের সরকার পতন ঝো লো’র জন্য চরম দুসংবাদ ছিল।
তিনি ক্ষমতা হারানোর পর ঝো লো’র বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আনা হয় এবং পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ তাকে খুঁজছে। বর্তমানে তিনি পলাতক- তিনি কোথায় আছেন কেউ জানে না। কিন্তু তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বিবৃতির মাধ্যমে তিনি নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে আসছেন। তার আইনজীবীরা বলছেন মালয়েশিয়াতে ঝো লো ন্যায়বিচার পাবেন না।
‘ঝো লো খুবই উদ্যমী ছিলেন। একদিকে তিনি যেমন কোনো কাজ পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষভাবে করতেন, অন্যদিকে তেমনি আবার খুবই গা-ছাড়া ভাব ছিল তার। অন্যের অর্থ দিয়ে দ্রুত নিজের একটা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তাই তার তড়িঘড়ি পরিকল্পনা আর সাফল্যের জন্য ব্যস্ততা শেষ পর্যন্ত টেকসই হয়নি,’ বলেন সাংবাদিক ও লেখক হোপ।
টিমোথি লেইসনার
দক্ষ জার্মান ব্যাঙ্কার- বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্সের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। যখন এই সংস্থা এশিয়ায় তাদের ব্যবসা প্রসারিত করে, সেসময় এশিয়ায় সংস্থাটির শীর্ষ প্রতিনিধি ছিলেন লেইসনার।
২০০৮-এর অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর, টিমোথি লেইসনার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়- বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় যেসব আর্থিক চুক্তি করেছিলেন, তার থেকে ব্যাঙ্কটি বিশাল পরিমাণ রাজস্ব লাভ করেছিল এবং ফলশ্রুতিতে লেইসনারের পদোন্নতি হয়েছিল। তিনি গোটা এলাকায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে বড় ব্যবসা এসেছিল যখন তার সাথে পরিচয় হয় ঝো লো’র। যিনি ওয়ানএমডিবি প্রকল্পের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী খেলোয়াড় ছিলেন বলে অভিযোগ।
বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্স প্রথমদিকে ঝো লো’র অর্থের উৎস সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে তাকে ক্লায়েন্ট হিসাবে নাকচ করে দিয়েছিল।
কিন্তু আমেরিকান অভিযোগ অনুযায়ী, ক্ষমতাশালী রাজনীতিকদের সাথে ঝো লো’র যোগাযোগ ব্যবহার করে লেইসনার এবং গোল্ডম্যান স্যাক্সের আরেকজন ব্যাংকার রজার ইং সংস্থাটির জন্য বড় ব্যবসা জোগাড় করেন।
ব্যাংকটি ২০১২ এবং ২০১৩ সালে ওয়ানএমডিবি তহবিলের জন্য ৬.৫ বিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের তিনটি বন্ড বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয় যার জন্য তারা ফি বাবদ আয় করেছিল ৬০ কোটি ডলার।
অর্থ ধোলাইয়ের ষড়যন্ত্রে অংশ নেবার এবং বিদেশি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে দুর্নীতি বিরোধী আইন ভাঙার দায়ে আনা আমেরিকান অভিযোগে লেইসনার দোষ স্বীকার করেন।
মালয়েশিয়াতেও লেইসনার, ইং এবং গোল্ডম্যানের ১৭ জন সাবেক ও বর্তমান ব্যাংকারকে অভিযুক্ত করা হয়। ব্যাংকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়।
জুলাই ২০২০-এ গোল্ডম্যান স্যাক্স এই দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে তাদের ভূমিকার জন্য মালয়েশীয় সরকারের সাথে ৩৯০ কোটি ডলারের একটি আপসরফা করে।
দেশটির রাষ্ট্রীয় তহবিলের জন্য ৬.৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ সংগ্রহের সময় বিনিয়োগকারীদের ভুল তথ্য দেয়ার যে অভিযোগ মালয়েশীয় সরকার এনেছিল সেই মামলায় এই অর্থ দিতে সম্মত হয়েছে গোল্ডম্যান।
তারকারা
লোকে বলে অর্থ কথা বলে, কিন্তু তারকারা কি অর্থের বিনিময়ে আরো জোর গলায় কথা বলেন?
মালয়েশিয়ার ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে নেই শুধু ক্ষমতাশালী রাজনীতিক আর অর্থ ব্যবসায়ীরা। পলাতক ব্যবসায়ী ঝো লো প্রায়ই হলিউডের প্রথম সারির তারকাদের সাথে পার্টি করে বেড়াতেন।
তাদের বিরুদ্ধে অবশ্য এখন পর্যন্ত অনিয়মের কোনোরকম অভিযোগই আনা হয়নি। কিন্তু ঝো লো’র সাথে তাদের সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি হয়েছে।
লিওনার্ডো ডিক্যাপ্রিওর সেই ছবিটি
অস্কারখ্যাত তারকা ডিক্যাপ্রিও ২০১৩ সালের ছবি ‘দ্য উল্ফ অফ ওয়াল স্ট্রিট’-এ অভিনয় করেছিলেন, যেটির সহ-প্রযোজক ছিলেন এবং অর্থ দিয়েছিলেন রোসমা মনসুরের ছেলে ও নাজিব রাজাকের সৎ-ছেলে রিজা আজিজ। লোভ ও দুর্নীতি নিয়ে তৈরি এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য ডিক্যাপ্রিও গৌরবময় গোল্ডেন গ্লোব সবসেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। তিনি পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে রিজা আজিজ এবং ঝো লো’কে ধন্যবাদ জানান।
আমেরিকান কৌঁসুলিরা বলেছেন, এই দুর্নীতির অর্থ দিয়ে ছবিটি বানানো হয়েছিল। প্রযোজক কোম্পানি রেড গ্র্যানাইট আমেরিকান সরকারকে দেওয়ানি মামলায় ছয় কোটি ডলার দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করে। তারা অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে।
তবে ২০১৯ সালে রিজা আজিজকে মালয়েশিয়ায় গ্রেফতার করা হয় এবং অর্থ সাদা করার পাঁচটি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ওয়ানএমডিবি তহবিল থেকে তছরুপ করা প্রায় ২৫ কোটি ডলার তাকে দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। তিনি অবশ্য সবগুলো অভিযোগে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন।
ডিক্যাপ্রিও ইতোমধ্যে আমেরিকান কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং পিকাসোর একটি চিত্রকর্ম, যেটি ঝো লো তাকে উপহার দিয়েছেন বলে অভিযোগ, সেটি ফিরিয়ে দিয়েছেন।
সঙ্গীতশিল্পী বন্ধু কাসিম ডিন এবং আলিসিয়া কিইস
উচ্চাকাঙ্ক্ষী রেকর্ড প্রযোজক এবং তার সুপারতারকা স্ত্রী একসময় ঝো লোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, তার বহুল আলোচিত সব জমকালো পার্টিতে ঝো লো’র সাথে তাদের ফটো প্রায়ই দেখা যেত। লাস ভেগাসে ঝো লো’র ৩১ বছরের যে জন্মদিনের পার্টিতে কেক ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন ব্রিটনি স্পিয়ার্স, সেই পার্টিতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন কাসিম ডিন।
বলা হয়, শিল্পকলা মহলের বিত্তশালীদের সাথে ঝো লো’র পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই সঙ্গীতশিল্পী। এই পরিচয়ের সূত্রেই ঝো লো ভ্যান গগের একটি এবং মনে-র দুটি চিত্রকর্ম কিনেছিলেন ওয়ানএমডিবি তহবিলের অর্থ ব্যবহার করে।
প্যারিস হিটলনের সাথে পার্টি
বিত্তশালী আরেক নারী, এই হোটেল মালিকও ছিলেন ঝো লো’র ঘনিষ্ঠ মহলের আরেকজন। তাদের পরিচয় ২০০৯ সালে। পাপারাজ্জি ফটোগ্রাফারদের তোলা ছবিতে দুজনকে অনেকবার একসাথে দেখা গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা পার্টিতে। জুয়ার টেবিল থেকে শুরু করে বিখ্যাত সব স্কি রিসোর্টের বরফ ঢাকা ঢালে। দুজনের একসাথে বেশ কিছু সেলফি ছবিও দেখা গেছে।
মিরান্ডা কার এবং এলভা সিয়াও’র সাথে ঘনিষ্ঠতা
এদের একজন অস্ট্রেলিয়ান সুপারমডেল এবং অন্যজন তাইওয়ানের গায়িকা ও নায়িকা। দুজনেই একসময় ছিলেন ঝো লো’র বান্ধবী।
মিরান্ডা বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে উচ্চ আয়ের মডেল। তার সাথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রমোদতরীতে ১০ দিন ধরে ঘুরে বেড়ানো এবং পরপর বেশ কিছুদিন ঘনিষ্ঠ মেলামেশার পর ঝো লো তাকে যেসব উপহার দেন তা চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবার মতো। যেমন ১০ লাখ ডলার মূল্যের একটা বিশাল পিয়ানো বাদ্যযন্ত্র, যেটি কাঁচের মতো স্বচ্ছ অ্যাক্রিলিক দিয়ে তৈরি অর্থাৎ যেটার মধ্যে দিয়ে দেখা যায়। এছাড়াও ১১ ক্যারেট হীরার নেকলেস ও দুল। মিরান্ডা কার অবশ্য পরে আমেরিকান কৌঁসুলিদের কাছে কয়েক কোটি ডলার মূল্যের গহনা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
বিলিয়ন ডলার হোয়েল বইতে বলা হয়েছে, ঝো লো তাইওয়ানী গায়িকা এলভাকে দুবাইয়ে ১০ লাখ ডলার খরচ করে ছুটি কাটাতে নিয়ে যান, সেখানে ব্যক্তিগত সমুদ্র সৈকতে বসে তারা নৈশভোজ করতেন।
সাংবাদিকরা
এই বিশাল দুর্নীতির কথা ও এর ব্যাপকতা কখনই মানুষ জানতে পারত না, যদি না বেশ কিছু সাংবাদিক বছরের পর বছর এই কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানে লেগে না থাকতেন। তারা একটার পর একটা খবরের বোমা ফাটিয়েছেন এবং তাদের ধৈর্য ও চাপ এই তহবিলের কাজকর্ম নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে বাধ্য করেছে।
ক্লেয়ার রিউকাসেল-ব্রাউন, দ্য সারাওয়াক রিপোর্ট
প্রায় এক যুগ আগে মালয়েশিয়ান বংশোদ্ভুত এই ব্রিটিশ সাংবাদিক মালয়েশিয়ার প্রভাবশালী রাজনীতিকদের নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। শিশুদের রাতে ঘুম পাড়িয়ে তিনি লন্ডনে তার রান্নাঘরে তথ্য অনুসন্ধানের কাজে বসতেন। তার সারাওয়াক রিপোর্ট ওয়েবসাইটে প্রথমদিকে তিনি নজর দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার একটি রাজ্যে কিছু অস্বচ্ছ কাজকর্মের ঘটনা ওপর। এরপর ওয়ানএমডিবি-র প্রথমদিকে যখন সারাওয়াকে একটি চুক্তি সম্পাদন করা হয়, তখন তিনি ওই চুক্তির দিকে নজর দেন, কারণ তার মনে হয়েছিল এতে ‘খুবই সন্দেহজনক একটা সংস্থা’ জড়িত আছে।
এরপর, ২০১৩ সালের শেষ দিকে একজন তাকে গোপনে জানায়, নাজিব রাজাকের সৎ-ছেলে হলিউডের ‘দ্য উল্ফ অফ ওয়াল স্ট্রিট’ ছায়াছবিটি প্রযোজনা করেছেন। ‘তখনই আমি খোঁজখবর করতে শুরু করি,’ তিনি বলেন। ‘আমার শুধু মনে হয়েছিল এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা স্টোরি।’ এরপর আর্থিক লেনদেনের খোঁজ নিতে নিতে যেসব তথ্য তিনি পেলেন এবং খবর করলেন, মালয়েশিয়ার পাঠক সেসব গোগ্রাসে পড়েছিল। মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ মিডিয়া এই খবর হয় করতে সক্ষম ছিল না নয় করতে চায়নি।
রিউকাসেল-ব্রাউন ২০১৫ সালের গোড়ার দিকে সুইজারল্যান্ডের একজন হুইসল ব্লোয়ার জাভিয়ের জাস্টোর কাছ থেকে ২ লাখেরও বেশি পৃষ্ঠার কিছু দলিল পান এবং তার ভিত্তিতে তিনি অভিযোগ তোলেন ওয়ানএমডিবি’র এক চুক্তি মোতাবেক ঝো লো নিয়ন্ত্রিত একটি সংস্থার অ্যাকাউন্টে সরাসরি ৭০ কোটি ডলার জমা পড়েছে।
এর কয়েক মাস পর ‘চাঞ্চল্যকর তথ্য!’ শিরোনামে তিনি বিস্তারিত তথ্য ফাঁস করে খবর করেন ২০১৩ সালে ওই ৭০ কোটি ডলার জমা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ তার ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয় এবং তাকে গ্রেফতারের জন্য সমন জারি করে।
‘সারা পৃথিবী থেকে লোকে আমার সাথে যোগাযোগ করে আমাকে তথ্য দিচ্ছিল। অবশ্যই সেগুলো সঠিক কিনা সেটা সাংবাদিক হিসেবে যাচাই করে দেখা আমার দায়িত্ব ছিল,’ তিনি বলেন। ‘এই অভিযোগ নিয়ে ঘটনা যখন তুঙ্গে, তখন লন্ডনে আমাকে ধরার জন্য গুন্ডা লাগানো হয়, তারা আমাকে অনুসরণ করত, আমার ছবি তুলত... আমাকে পুলিশে খবর দিতে হয়েছিল।’
টম রাইট ও ব্র্যাডলি হোপ, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল
এই দুই সাংবাদিক তাদের বই বিলিয়ন ডলার হোয়েল-এ ঝো লো’র কার্যকলাপের পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিস্তারিত তুলে ধরেন। বইটি মালয়েশিয়ায় রেকর্ড বিক্রি হয়।
তারা দুজনে কয়েক বছর ধরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের জন্য ওয়ানএমডিবির আর্থিক লেনদেনের খবর নিয়ে অনসুন্ধানমূলক সাংবাদিকতা করছিলেন।
‘কিন্তু সাধারণত ২০০০ শব্দের বেশি খবর লিখলে কেউ তা পড়ে না। এই শব্দসীমা বজায় রাখতে গিয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর খুঁটিনাটি আমাদের বাদ দিতে হচ্ছিল,’ বলেন হোপ। ‘আমরা জানতাম এই দুর্নীতি কেলেঙ্কারির ফলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু বিশেষ করে ঝো লো’র সম্পর্কে এত সাড়া জাগানো তথ্য ছিল তা আর্থিক কেলেঙ্কারির থেকেও বেশি রসালো।’
হোপ বলেন, এই কেলেঙ্কারি মালয়েশিয়ার জন্য যে কী বিশাল এই বই তারই দলিল।
‘দেশটিতে এই আর্থিক অনিয়ম নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিল। কিন্তু বইয়ে আমরা যেভাবে তথ্য উপাত্ত দিয়ে এই দুর্নীতির সার্বিক চিত্র তুলে ধরেছি, তাতে স্পষ্ট বলা যায়, ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারি বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে বড় একটা আর্থিক দুর্নীতি।’
এই বই প্রকাশের পর ঝো লো-কে ধরার জন্য বিশ্ব জুড়ে একটা চাপ তৈরি হয়।
দ্য এজ, মালয়েশিয়া
ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারি ২০১৫ সালে যখন খবরের শিরোনামে তখন মালয়েশিয়ার ভেতরে আপনি যদি শুধুই মালয়েশীয় পত্রিকা পড়তেন বা শুধু দেশের টিভি চ্যানেলে খবর শুনতেন তাহলে আপনার মনে হতো কিছুই হয়নি, সব ঠিকঠাক আছে। মালয়েশিয়ার বেশিরভাগ সাংবাদিক ও সম্পাদকরা দ্রুত বুঝে গিয়েছিলেন যে, দেশের রাষ্ট্রীয় ফান্ড নিয়ে এই কেলেঙ্কারির খবর নিয়ে বেশি ঘাঁটালে বিপদ আছে এবং এ খবর প্রচার করলে তাদের কাজ করার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবার ঝুঁকি আছে।
কিন্তু গুটিকয় যেসব সংবাদমাধ্যম এই খবর দেয়া থেকে বিরত হয়নি তাদের মূল্য দিতে হয়েছে। এদের একটি দ্য এজ মিডিয়া গ্রুপ।
তাদের সংবাদপত্রগুলো ওয়ানএমডিবির কার্যকলাপ নিয়ে তদন্তের খবর ছেপেছে এবং ‘জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে সংবাদ প্রচারের’ কারণ দেখিয়ে তাদের লাইসেন্স স্থগিত করে দেয়া হয়েছে।
সেসময় সংবাদপত্রের প্রকাশক হো কে টাট বলেছিলেন, ‘আমাদের মুখ বন্ধ করতেই শুধু আমাদের কাগজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
সূত্র : বিবিসি