কেন তেহরান থেকে রাজধানী স্থানান্তরের কথা ভাবছে ইরান?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৫, আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৬

ইরানের রাজধানী তেহরান বর্তমানে যানজট ও ভূপৃষ্ঠ দেবে যাওয়াসহ অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত। এতো সব সমস্যার মধ্যেই দেশটির সরকার রাজধানীকে ওমান উপসাগরের একেবারে ভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত করার কথা বিবেচনা করছে।
ইরানের রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়টি নতুন নয়। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই স্থানান্তরের ধারণাটি বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। কিন্তু বিশাল আর্থিক ও লজিস্টিক বাধার কারণে প্রস্তাবগুলো বারবারই অবাস্তব বলে স্থগিত করা হয়েছে।
সম্প্রতি সংস্কারবাদী প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান তেহরানের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে এ ধারণাটি পুনরুজ্জীবিত করেছেন।
তিনি তেহরানের বাড়তে থাকা সংকটের কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে যানজট, পানির ঘাটতি, সম্পদের অব্যবস্থাপনা, চরম বায়ু দূষণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বা মানুষের কার্যকলাপের কারণে ভূপৃষ্ঠ ধীরে ধীরে দেবে যাওয়া।
জানুয়ারিতে সরকারের মুখপাত্র ফাতেমেহ মোহাজেরানি জানিয়েছিলেন, কর্তৃপক্ষ সম্ভাব্য স্থানান্তরের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
তিনি কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট না করেই রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়ে বলেন, ‘মাকরান অঞ্চলটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে।’
মাকরান মূলত ওমান উপসাগরের একটি অনুন্নত উপকূলীয় অঞ্চল। এটি ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশ ও প্রতিবেশী হরমোজগান প্রদেশের অংশ জুড়ে বিস্তৃত। মাকরানে রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়টি বারবার বিবেচনা করা হয়েছে।
রোববার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এক ভাষণে বলেন, ‘মাকরানের হারানো স্বর্গকে ইরান ও এই অঞ্চলের ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে হবে।’
সেপ্টেম্বরে পেজেশকিয়ান বলেছিলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র দক্ষিণে সমুদ্রের কাছাকাছি স্থানান্তর করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই।’
নতুন করে শুরু হওয়া স্থানান্তরের বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা নিয়েও দেখা দিয়েছে বিতর্ক। এর পেছনে অনেকেই তেহরানের ঐতিহাসিক ও কৌশলগত তাৎপর্য তুলে ধরেছেন।
আইনপ্রণেতা আলি খাজায়ি জানান, যে শহরই বেছে নেয়া হোক না কেন ইরানের ‘সমৃদ্ধ সংস্কৃতি’ বিবেচনায় নিতে হবে।
১৭৮৬ সালে আগা মোহাম্মদ খান কাজারের মনোনীত রাজধানী তেহরান দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইরানের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে আসছে।
গভর্নর মোহাম্মদ সাদেঘ মোতামেদিয়ানের মতে, বর্তমানে তেহরানে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ বসবাস করেন এবং প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ নানা কাজে সেখানে যাতায়াত করেন।
এদিকে মাকরান জেলেদের গ্রাম, বালুকাময় সৈকত এবং আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের সময়কার প্রাচীন ইতিহাসের জন্য পরিচিত।
তবুও অনেকেই সম্ভাব্য স্থানান্তরের বিরোধিতা করছেন। তেহরানের বাসিন্দা ২৮ বছর বয়সী প্রকৌশলী কামিয়ার বাবাই বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ ভুল একটি পদক্ষেপ। কারণ তেহরানই ইরানের প্রতিনিধিত্ব করে।’
তিনি বলেন, ‘এই শহরটি ঐতিহাসিক কাজার রাজবংশ, আধুনিকতা ও নগর জীবনের প্রতীক,"
একইভাবে নগর পরিকল্পনা অধ্যাপক আলী খাকসার রাফসানজানি তেহরানের ‘কৌশলগত অবস্থানের’ কথা উল্লেখ করেছেন। ইরানের সংবাদপত্র এতেমাদকে তিনি বলেন, ‘শহরটি জরুরি ও যুদ্ধ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে নিরাপদ ও উপযুক্ত। অন্যদিকে মাকরান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এটি ওমান উপসাগরে অবস্থিত।’
এদিকে তেহরানের সাবেক মেয়র পিরুজ হানাচি জানান, বিনিয়োগ ও শহরটির উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে রাজধানীর সমস্যাগুলো সমাধান করা যেতে পারে।
কিন্তু এ সমস্যা মোকাবেলায় ঠিক কী পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে গত বছরের এপ্রিলে ইরানের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, রাজধানী স্থানান্তর করতে হলে প্রায় ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন পড়বে।
স্থানীয় বার্তাসংস্থা আইএসএনএ মাকরানে যাওয়ার সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে বলেছে, এই অঞ্চলের ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা’ রয়েছে।
কিন্তু এটি আরো উল্লেখ করে বলেছে, রাজধানী স্থানান্তরের জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন পড়বে তা দেশটির সংকটে থাকা আর্থিক খাতের জন্য বাড়তি বোঝায় পরিণত হবে। গত কয়েক দশক ধরে নানা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এতেমাদ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, তেহরান ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। তেহরানের তুলনায় মাকরানে বরং ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি কম। একইসাথে আঞ্চলিক উন্নয়নের সুযোগ ও সমুদ্র ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাবে।
খবর অনলাইন নামে আরেকটি সংবাদমাধ্যমও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মাকরান অঞ্চলের ঝুঁকির দিকে ইঙ্গিত করেছে।
পরিবেশবিদ হোসেইন মোরাদির উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন, মাকরান অঞ্চলে জলসম্পদের অভাব, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত হ্রাসের সাথে মিলিত হয়ে অত্যন্ত নাজুক পরিবেশগত পরিস্থিতি তৈরি করেছে যা উন্নয়নের সম্ভাবনাকে সীমিত করে।
সূত্র : এনডিটিভি