০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ৮ রজব ১৪৪৬
`

পতনের পথে মিয়নামারের জান্তা সরকার!

মিয়ানমারের জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। - ছবি : সংগৃহীত

মিয়ানমারের পরিণতি কি সিরিয়ার মতোই হতে যাচ্ছে তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিশ্লেষণ। সিরিয়ায় ২০২৪ সালের শেষভাগে আসাদ পতন মিয়ানমার প্রতিরোধ ও তার সমর্থকদের কল্পনায় রসদ যোগাচ্ছে। মিন অং হ্লাইং- এর অপরাধমূলক শাসন কি একইভাবে দ্রুত পতনের মুখে পড়তে পারে? যদি পড়ে, তাহলে তা কেমন হবে? মিয়ানমারের গণমাধ্যম ইরাবতির এক প্রবন্ধে ডেভিড স্কট মাথিসন এমন প্রশ্ন করেছেন। প্রবন্ধটির চুম্বুক অংশ নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আফরা সাইয়ারা পরমা

এ বিষয়টি বুঝতে হলে প্রথমে ‘পতনের’ সংজ্ঞাটি ব্যাখ্যা করতে হবে। এটি কি রাজ্য প্রশাসন পরিষদ যন্ত্র বা সামগ্রিকভাবে সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? সমারিক বাহিনী বহাল থাকলে, এক জান্তার পতনের ফলে সম্ভবত আরেক জান্তার পতন ঘটতে পারে। পর্যবেক্ষরা বেশ কিছুদিন ধরেই অনুমান করছেন যে উপ-প্রধানমন্ত্রী সো উইনের অধীনে কোনো বিকল্প শাসন আরো বেশি নির্মম হতে পারে।

সিরিয়ার সাথে মিয়ানমারের তুলনা শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রেই উপযোগী হতে পারে, তা হলো আসাদ পতনে যেই প্রধান কারণগুলো ভূমিকা রেখেছে তা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে হচ্ছে না। এই সংঘাতের গতিপ্রকৃতি মৌলিকভাবে ভিন্ন। রাজনৈতিক ও সামরিক সংস্কৃতি ও একইভাবে ভিন্ন। এটা বলা যেতে পারে যে জেনারেলরা আন্তর্জাতিক উন্নয়নের উপর অস্পষ্ট ধারণা রাখেন। তারা আসাদের দ্রুত ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় অস্বস্তিতে পড়তে পারেন।

২০১৫ সালে দেশব্যাপী নির্বাচনের আগে সে সময়ের ক্ষমতাসীন দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) একটি নির্বাচনী বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিল যাতে আরব বসন্তের পরে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল তার বিপরীতে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের শান্তিপূর্ণ নেতৃত্ব ফুটে উঠেছিল। এ থেকে বোঝা যায়, জেনারেলরা কিছু পরিমাণে বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত। মিন অং হ্লাইং স্পষ্টতই সেই বিজ্ঞাপনটিকে উপেক্ষা করেছিলেন। তিনি মাত্র পাঁচ বছর পরেই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার একটি সংস্করণ ছড়িয়েছিলেন।

তবে সিরিয়ার প্রসঙ্গটা রয়েই যায়। ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ডুয়া লাশি লা সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ২০২৫ সালে একটি শিখর শীর্ষ বা ‘টিপিং পয়েন্টে’ পৌঁছানো, অর্থাৎ সিরিয়ার মতো একটি পরিস্থিতিতে পৌঁছানো যখন বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের স্টেট অ্যাডমিনিসট্রেশন কাউন্সিলের (এসএসি) বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত করতে হবে। তবে এই ক্রান্তিকালে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। আমরা বিশ্বাস করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও এসএসির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি এবং সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এসএসি একবারেই ধ্বংস করা সম্ভব।’ তবে এটির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন (ইএও) নেতাদের যৌথ কৌশল, যারা কী পরিকল্পনা করছে তা প্রচার করা থেকে বিরত থাকে।

লাশি লা যা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছেন তা হলো, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার উৎস কোথায়। চীন এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে সব থেকে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অভ্যুত্থানের পরপরই পশ্চিমারা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, কোনো ধরনের সামরিক সহায়তা কখনোই আসবে না।

মিয়ানমারের অনেক রাজনৈতিক নেতা আশাবাদী এবং যেকোনো বিজয়ের পর শাসন ও সহযোগিতার বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলোকে কম ভূমিকায় রাখার জন্য সমালোচিত হয়েছেন। স্কলার নি নি কাও সম্প্রতি বসন্ত বিপ্লবে ‘নেতৃত্বের ঘাটতি’ সম্পর্কে জোর দিয়ে লিখেছেন। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ের পর রাতারাতিভাবে এই অভাব পূরণ হবে না। বরং এটি আরো বাড়তে পারে। কারণ এনইউজি কর্মকর্তারা ক্ষমতার জন্য নিজেদের মধ্যে লড়াই করে। এছাড়াও কারা দেশের অভ্যন্তরে ছিল এবং কারা পশ্চিমে বসবাস করেছিল তা নিয়ে তিক্ত বিতর্ক অভিজাতদের আরো বিভাজন তৈরি করে।

জান্তা শাসনের পতনের পর আন্তঃসংঘাতের আশঙ্কা খুবই বাস্তব। মিয়ানমারে আন্তঃগোষ্ঠীদের মধ্যে সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো (ইএও) দেশের অনেক অংশে কাজ করে। তারা মূলত ভ্রাতৃহত্যা বৃদ্ধি রোধে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে, বিশেষ করে উত্তর শান রাজ্যের মতো জটিল যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু চীন ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলে গতিশীলতার দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক বিপ্লবী শক্তির মধ্যে সহিংসতা বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, সাগাইং-এর বেশিভাগ সহিংসতা ‘বিপ্লবী গ্রাম’ ও জান্তা-পন্থী সম্প্রদায়ের মধ্যে হচ্ছে। এটি এমন একটি চক্র যা পারস্পরিক নৃশংসতা, অগ্নিসংযোগ ও বিতর্কিত রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতিশোধের মাধ্যমে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। জান্তার পতন হলে পরিচয়, সম্পদ ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিযোগিতা খুব সহজেই বাষ্পীভূত হবে না। তাই জান্তা শাসন পতনের পরের দিনই মিয়ানমার একটি কল্পরাজ্যে পরিণত হবে এমন ধারণা কল্পনা করা বিপজ্জনক।


আরো সংবাদ



premium cement