১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মেঘনা নদীর বাঁকে

মেঘনা নদীর বাঁকে - ছবি : সংগ্রহ

গ্রামের নাম বাঁশগাড়ি। চারপাশে মেঘনা নদী, সবুজ গাছ। গাছে গাছে পাখির কুজন, শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। দূর থেকে দেখে মনে হয় সবুজ ঘেরা বনাঞ্চল । গ্রামের ভেতর মসজিদ, মন্দির, স্কুল, মাদরাসা, কৃষিজমি। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে বড় কাঁচা রাস্তা, যাকে গ্রামের ভাষায় বলে গোপাট। অসম্ভব সুন্দর গ্রাম ওই গ্রামে আমার পূর্ব পুরুষের বসবাস। আমার আব্বার জন্ম, বেড়ে ওঠা ওই গ্রামে । এক সময় লেখাপড়ার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন। সেই যে আসা আর গ্রামে ফিরে যাওয়া হয়নি। জীবনটা বোধ করি এরকমই- কোথায় শুরু কোথায় যে শেষ হয় ,কেউ জানি না। জীবন স্রোতে ভেসে যাওয়া জীবনের গতি যেভাবে শুরু হয় সেভাবে শেষ হয় না। ভাসতে থাকে ছোট পুকুর, পুকুর থেকে নদী, নদী থেকে সাগর তারপর তার ঠিকানা শেষ। সেই জীবন স্রোতে আমার আব্বা শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন। সরকারি চাকরি করায় কয়েক বছর পরপরই বদলে করা হতো। সেই সুবাদে বিভিন্ন জেলা, থানা, মফস্বল শহরে থাকতে হয়েছে।

সেবার আমরা নরসিংদী এসেছি। নরসিংদী থেকে আমাদের গ্রামটা খুবই কাছে ৷ স্কুল ছুটি হলেই চলে যেতাম গ্রামের বাড়ির দাদির কাছে। দাদির কাছে থাকতে খুব পছন্দ করতাম । আমার দাদি ছিলেন বিচক্ষণ ও জ্ঞান বুদ্ধিতে অনন্যা এবং শিক্ষিত । নয় ছেলেমেয়ে রেখে আমার দাদা মারা যান। সেই থেকে দাদি এক হাতে সব ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছেন। দাদা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবি। দাদার চাকরি থেকে অবসর হওয়ার আগে দাদি গ্রামে চলে আসেন এবং বিষয়-সম্পত্তি কৃষিকাজ দেখাশুনা করতেন ৷ সবকিছু মিলিয়ে দাদি ছিলেন সর্বেসর্বা।

গ্রামের মানুষের যত সমস্যা সব সমস্যা সমাধানই দাদির কাছে থাকত, নানা কাজে দাদির পরামর্শ নিত। দাদিকে সবাই সম্মান করত এবং ভালোবাসতেন। একসময় দাদি ছিলেন বাড়ির সবচেয়ে ছোট বউ। তবে জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনায় তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে অনেক বেশি ৷সময়ের পরিক্রমায় দাদি হয়ে ওঠেন সবার বড় ।

ওই গ্রামের দুই ভাইয়ের এক বোন সিদ্দিমা। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে দিয়ে দেয়া হলো পাশের গ্রাম চরমধুয়ায়। সচ্ছল পরিবার, কাছাকাছি গ্রাম হওয়ায় মাঝেমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতেন বাবা-মাকে দেখতে। মন পরে থাকে বাপের বাড়ির দিকে। এটাও ঠিক একটা মেয়ের যখন বিয়ে হয়, পরকে আপন করতে অনেক সময় লাগে ৷একসময় সেই অজানা অচেনা পরিবার নিজের হয়ে যায় মনের অজান্তে । তো সিদ্দিমার পরিবারের সদস্য ভালো হওয়ায় সবাই তাকে আদর করতেন, যদিও গ্রামের কম শিক্ষিত শাশুড়িদের মানসিকতাই ছিল বউদের জ্বালানো। সেই অনুযায়ী তার শাশুড়ি অনেক ভালো ছিল, সিদ্দিমাকে বাবার বাড়ি আসার অনুমতি দিতেন। তাই মাঝে মধ্যে চলে আসতেন বাবার বাড়ি। আসার সময় ভাইয়ের ছেলে, মেয়ে, বাবা, মার জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসতেন। মুড়িমুড়কি, বাতাসা, কদমা, গাছের শিম, আলু, পটল ইত্যাদি। ভাই-ভাবিদের খুশির সীমা থাকত না। বড়ভাবি ডাকে, 'আয় সিদ্দিমা আয় আমার ঘরে আয়, আজ বেড়াইয়া যাবি।' দুই ভাবির আপ্যায়নের সীমা নাই । সিদ্দিমার ছেলে হলো, মেয়ে হলো। সংসার পুরনো হলো, মা-বাবা মারা গেলেন। গৃহস্তের সংসার ধান চাল শস্যের কোনো অভাব নেই, ধনেজনে পূর্ণ সংসার।

সময় বয়ে যায় এখন আর বাপের বাড়িকে নিজের বলে না। মনের অজান্তে শ্বশুরবাড়ি নিজের হয়ে গেল। তারপরও বলতে পারে না, এটা আমার বাড়ি। এটা বাপের বাড়ি আরেকটা শ্বশুর বাড়ি। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছেন। একদিন তার স্বামী আফাজউদ্দিন জ্বর অনুভব করলেন ৷ ঠান্ডা -কাশি ৷ কোনো পাত্তা না দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন ৷ বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল, কাশি কমছে না। নানা জটিলতা দেখা দিতে লাগল। অবশেষে নবীনগর শান্তি ডাক্তারের কাছে নেয়া হলো। ওই সমর শান্তি ডাক্তার দু' চার পাঁচ গ্রামের মধ্যে সেরা । খুব ভালো চিকিৎসক, গরিব মানুষের কাছ থেকে তেমন টাকা পয়সা নিতেন না ৷কিছুদিন চিকিৎসা করানোর পর কোনো রোগ ধরতে না পেরে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন৷ প্রচণ্ড রকমের কাশি, কিছুতেই কমছে না ৷ চিকিৎসা মানেই তো বিশাল খরচ ৷ জমি বিক্রি করে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করানো হলো কয়েক মাস। অবশেষে শনাক্ত করা হলো ফুসফুস ক্যান্সার। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে শেষ চেষ্টা করা হলো। সেইসাথে জমিও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না। তিন মেয়ে, এক ছেলে ৷ তিন মেয়ে বড়, ছেলে ছোট ৷ তাদের লেখাপড়া মাত্র শুরু ৷তাদের নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই অনেক কষ্ট, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন টাকা ৷একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটাই নেই। বড় মেয়ে একটু বড় হয়েছে, কলেজে যেতে হলে অনেক টাকার দরকার। ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেবে। বিয়ে ঠিক হলো, টাকার প্রয়োজন ৷

নিয়মানুযায়ী মেয়েকে বিয়ে দিতে টাকার তেমন প্রয়োজন নেই। কিন্তু সমাজব্যবস্থা এমন এক পর্যায় এসেছে- আপনার মেয়েই তো ব্যবহার করবে, একটা খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা আলমারি ইত্যাদি নানা আসবাবপত্রের বায়না, আমার আত্মীয়-স্বজন আছে, দু'শ' বরযাত্রী না এলে মানসম্মান তো থাকে না ৷ যেভাবে হোক মেয়ের অভিভাবককে এটা যোগার করতেই হবে ৷ ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী ছেলে মোহরানা দিয়ে, মেহমানদের খাবার খরচ করে বউ ঘরে নিয়ে যাবে। কিভাবে যে মেয়ের অভিবাবকের ওপর ভোজাটা চাপানো হলো সে প্রশ্নটা সবার কাছে?

যেভাবেই হোক, টাকার জোগার করতে হবে। সিদ্দিমা গেলেন তার ভাসুর-দেবরের কাছে। তারা তাকে এখান ধারে কাছে ঘেঁষতেও দেন না। কিভাবে দায়িত্ব থেকে দূরে থাকবে, সেটা নিয়ে ব্যস্ত। এখানেও শেষ নয়, ভাইয়ের ভাগ কিভাবে কম দেবে, তা নিয়ে ফন্দি ফিকির করছে। অবশেষে নিজের ভাইদের দ্বারস্ত হলো। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির চাইলে সেখানে তাদের আপত্তি। বাবার সম্পত্তি বোনেরা পায় না কি? এ নিয়ে নানা ভর্ৎসনা। বোন এখন সবচেয়ে অপছন্দ হয়ে উঠে। অবশেষে তার ছোট চাচি সিদ্দিমার পক্ষে কথা বলে কিছু সম্পত্তি দেয়ার রাজি করান ৷ তার সম্পূর্ণ অংশ অর্ধেক দাম নিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য হয়, কিনল তার দুই ভাই। তারা জানান, ভাই-বোনের জমি এভাবেই বেচা-কেনা হয় ৷ দশ টাকার জমি পাঁচ টাকায় কিনে নিয়েছে৷ অথচ ভাইদের আর্থিক অবস্থা বোনের চেয়ে অনেক অনেক গুণ ভালো। এটা নিতে অনেক অনুরোধে, হাতে-পায়ে ধরে রাজি করানো হয় । তবে গ্রামের কিছু মানুষ সমালোচনা করে 'আহারে বাপের সম্পত্তি নিলে সংসার উজায় না।' সবার মুখে মুখরোচক আলোচনা, 'হুনছছ সিদ্দিমা হের বাপের জমি ভাইদের কাছ থেকে লইয়া গেছে ৷ ছিঃ ছিঃ ছিঃ কেউ বাপের বাড়ির জমি নেয়! এই সংসার উজাইব না আরো নিচে যাইব।' আরো নানা গুঞ্জন।

হায় রে দুনিয়া! আর্থিক ভাবে দুর্বল হওয়ার সাথে সাথে সামাজিক, শারীরিক , মানসিক, পারিবারিক, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব- সব দুর্বল হতে থাকে। কেউ তার খবরও রাখে না। চোখের পানি ছাড়া তার কোনো কূল কিনারা নেই। চোখের পানি ঝরে, আর আল্লাহকে ডাকে। বড় মেয়ের বিয়ে হলো । মাঝে মাঝে নাড়ির টানে ভাইয়ের বাড়ি আসে। উঠানে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ তাকে ঘরে আসতে বলে না, কথা বলে না। বাপের বাড়ি আসে, হেঁটে চলে যায়। সিদ্দিমার ছোট চাচি আমার দাদির কাছে আসেন। দাদি খুব আদর করে, জোর করে ভাত খাইয়ে দেন। কান্না করে তার ছোট চাচির কাছে বলেন, 'ভাই-ভাবি কেউ কথা কয় না। কতক্ষণ উডানে বইয়া রইলাম, কেউ চাইয়া দেহে না, চাচি গো ভাই তো মায়া লাগে। এর লাইগ্যা দেখতে আই। আমার লগে এমুন করে কান্দুন আয়ে ৷ হের বাফে মরার সময় কিছু টেহা নিছিলাম হেই খোডা দেয়। সব লইয়া গেছে আবার আয়ে কেন? খোডা হুনতে আর বাল লাগে না। মনডারে বাইন্দা রাহি, এই গেরামে আর আমু না। পারি না চাচি। তোমগরে না দেইখা থাকতে পারি না। এইবার শেষ, আর আমু না।'

দুঃখে কষ্টে বলেন, আর 'আমু না,' কিন্তু না এসে আর পারে না। কয়েক দিনপরই তার মন ব্যাকুল হয়ে যায়। আবার আসেন। তখন আমি ছোট। দাদির কাছে জানতে চাইলাম, কেন এমন করে ওরা। দাদী বলেন, বাপের জমির অংশ ভাইদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে- এটাই তার অপরাধ। গ্রামে কেউ জায়গা জমি নেয় না। কিন্তু মেয়েরাও বাবার সম্পত্তির অংশ পাবে সেটা তারা জানে। তবে দিতে চায় না অথবা মানতে চায় না ৷মানুষের জীবন লতাপাতার মতো । লতাপাতা যেমন অন্য গাছকে আঁকড়ে ধরে বাঁচে। মানুষও তেমনি অন্য মানুষকে আঁকড়ে ধরে বাঁচে। প্রথম জীবনে মা-বাবা, ভাই-বোন, তারপর স্বামী, ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি ৷আদর-স্নেহ, ভালোবাসা নিম্নমুখী- এক ডাল থেকে অন্য ডালে ৷

এভাবেই দুখের দিন শেষ হলো। মেয়েদের বিয়ে হলো। সুখেই আছে সবাই। ছেলে বড় হয়েছে। ব্যবসা করে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। ছেলেমেয়ে তাদের মাকে মাথায় করে রাখে।

এখন সিদ্দিমা বসবাস করেন ছেলের বাড়ি। এখন অনেক সম্পদে সমৃদ্ধ। শাড়ি -ব্লাউজ, গহনা- অনেক। অনেক খাবার, যা অল্প বয়সে তিনি চোখেও দেখেনি। কিন্তু এত কিছু ভোগ করার বয়স সিদ্দিমার নেই।


আরো সংবাদ



premium cement