উপসম্পাদকীয়

ফাইভ-জি ইন্টারনেট, পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সব সময়ই বিশ্বে নতুন নতুন বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে। ইউরোপের শিল্প-বিপ্লব মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে এবং ধীরে ধীরে বর্তমান আধুনিক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার শিল্প বিপ্লবের চতুর্থ ধাপে পা রাখল আধুনিক বিশ্ব। মজার ব্যাপার হলো, সর্বশেষ এই বিপ্লবের সূতিকাগার সব সময়ের মতো ইউরোপ বা আমেরিকা নয়। এবারের বিপ্লবের সূচনা হলো এশিয়ার দেশ, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে।

গত ৫ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ায় মোবাইল ইন্টারনেট সেবার পঞ্চম প্রজন্ম অর্থাৎ ফাইভ-জি প্রযুক্তি চালু করার মধ্য দিয়ে নতুন এই বিপ্লবের অগ্রযাত্রার সূচনা হয়েছে। এদিন বিশ্বের প্রথম ফাইভ-জি ফোন নিয়ে এসেছে সে দেশের বৃহত্তম মোবাইল কোম্পানি স্যামসাং। উন্মোচন করা হয়েছে বিশ্বের প্রথম ফাইভ-জি প্রযুক্তি-সমর্থিত ফোন ‘গ্যালাক্সি এস১০ ৫জি’। বলা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি সর্বত্র চালু হলে বিশ্বে এক নতুন বিপ্লব ঘটবে। ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে বর্তমান ফোর-জি নেটওয়ার্কের চেয়ে ২০ গুণ এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ১০০ গুণ বেশি গতি পাওয়া যাবে। ফলে বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ করা যাবে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। এতে করে তারহীন প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল ও বুদ্ধিবৃত্তিক যন্ত্রাংশে সামাজিক উৎপাদনশীলতা বিপুলভাবে বাড়বে। দক্ষিণ কোরিয়া আশা করছে, তাদের বর্তমান মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ফাইভ-জির মাধ্যমে সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। এএফপির খবরে বলা হয়, গত ৩ এপ্রিল বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে ফাইভ-জি প্রযুক্তি সেবা সরবরাহ শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে তিনটি কোম্পানি তাদের গ্রাহকদের এত দ্রুতগতির ইন্টারনেট-সেবা দিচ্ছে যে, পুরো একটি সিনেমা ডাউনলোড করতে এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগছে!

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কৃষি ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা শিল্পায়নের দিকে এগোতে শুরু করলে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিস্ময়কর পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তনই ‘শিল্প বিপ্লব’ নামে পরিচিত। মানবসভ্যতার ইতিহাসে তিনটি শিল্প বিপ্লবে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে মানব জাতির জীবনযাত্রা প্রণালীতে। ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি এবং ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের জীবনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কার হওয়ার ফলে কায়িক শ্রমের বিপরীতে মস্তিষ্কপ্রসূত জ্ঞানের বিপ্লব ঘটে গেছে এবং শিল্পোৎপাদনের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়েছে। এই তিন বিপ্লবের যত অর্জন, তার সবকিছু পেছনে ফেলে এখন এসে গেল ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ বিপ্লব। এর সবচেয়ে বড় উপাদান হতে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এবং তথ্যপ্রযুক্তির যাবতীয় অনুষঙ্গ। প্রতিটি ক্ষেত্রে রোবোটিক্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার মানবজাতির জন্য বিপুল কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার হলে তা মানবজাতির জন্য অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে, এমন আশঙ্কা আছে। কিন্তু সেটা তো খোদ বিজ্ঞান নিয়েও আছে। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কার পারমাণবিক বোমার মজুদের কারণে বিশ্ব একটি মহা বিপন্ন অবস্থায় ঝুলে আছে। তা বলে বিজ্ঞানের চর্চা বন্ধ করে দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই।

বহুদিন ধরে আলোচনা এবং এরই মধ্যে দেশে ফোর-জি ইন্টারনেট-সেবা চালু হওয়ায় অনেকেই ফাইভ-জি কী, সেটা জানেন। মোবাইল ফোনের পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবাই আসলে সংক্ষেপে ফাইভ-জি; যেখানে অনেক দ্রুত গতিতে ইন্টারনেটে তথ্য ডাউললোড এবং আপলোড করা যাবে। এটি রেডিও তরঙ্গের আরো বেশি ব্যবহার নিশ্চিত করবে এবং একই সময় একই স্থানে বেশি মোবাইল সেটে ইন্টারনেটের সুবিধা দেবে।
ফাইভ-জি মোবাইল নেটওয়ার্ক মানুষের জীবনে কতটা পরিবর্তন আনবে তা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন। ধারণা করা হয়, হয়তো ড্রোনের মাধ্যমে গবেষণা এবং উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে, অগ্নিনির্বাপণে সহায়তা করবে। আর সেসবের জন্যই ফাইভ-জি প্রযুক্তি সহায়ক হবে।

তবে চালকবিহীন গাড়ি, লাইভ ম্যাপ এবং ট্রাফিক তথ্য পড়ার জন্য ফাইভ-জি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ‘মোবাইল গেমার’রা আরো বেশি সুবিধা পাবেন। ভিডিও কলে কথা এবং ছবি আরো স্পষ্ট ও পরিষ্কার হবে। সহজে এবং কোনো বাধা ছাড়াই মোবাইলে ভিডিও দেখা যাবে। শরীরে লাগানো ফিটনেস ডিভাইসগুলো নিখুঁত সময়ে সঙ্কেত দিতে পারবে, জরুরি চিকিৎসাবার্তাও পাঠাতে পারবে। সবকিছু মিলিয়ে তারবিহীন এই ইন্টারনেট-সেবা বর্তমানের ফোর-জির চেয়ে অনেকটাই আলাদা ও উন্নত। এটা একেবারে নতুন একটি বেতার প্রযুক্তি।

এখন সারা বিশ্বেই আলোচনা ও গবেষণা চলছে পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট বা ফাইভ-জি নিয়ে। অনেক দেশে আগামী বছরের মধ্যেই এই সেবা চালু হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়ায় চালুর কয়েক ঘণ্টা পরই যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম টেলিকম প্রতিষ্ঠান ‘ভেরাইজন’ শিকাগোসহ দু’টি শহরে বাণিজ্যিকভাবে ফাইভ-জি সেবা দেয়া শুরু করেছে। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে ১২টি শহরে বাছাইকৃত কিছু ব্যবহারকারীর জন্য ফাইভ-জি সেবা উন্মুক্ত করেছিল ভেরাইজনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি, এটিঅ্যান্ডটি।
তার মানে হলো, বিশ্বে গত বছরই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সেটির উদ্বোধন ঘটাল দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বের সব দেশই ফাইভ-জি প্রযুক্তি দ্রুত চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বেশির ভাগ দেশ ২০২০ সালের মধ্যে এই সেবা চালু করতে চায়। এদিকে, কাতারের ওরেডো কোম্পানি জানিয়েছে, তারাও বাণিজ্যিকভাবে সেবাটি চালু করেছে। চীন শিগগিরই এই সেবা চালু করবে। কারণ তারা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে তারা বিশ্বকে সিক্স-জি প্রযুক্তি উপহার দেবে। আর সেই ঘোষণা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যথার অন্ত নেই।

প্রথমেই হয়তো দ্রুতগতির বিষয়টি নজরে আসবে না। কারণ নেটওয়ার্ক অপারেটররা বর্তমান ফোর-জি নেটওয়ার্ককে ফাইভ-জিতে বাড়িয়ে গ্রাহকদের আরো উন্নত সেবা দিতে চাইবেন। দ্রুতগতির বিষয়টি নির্ভর করবে যে, কোন স্পেকট্রাম ব্যান্ডে ফাইভ-জি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং মোবাইল কোম্পানিগুলো মাস্ট আর ট্রান্সমিটারের পেছনে কতটা বিনিয়োগ করছেন। বর্তমানের ফোর-জি প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক গড়ে সর্বোচ্চ ৪৫ এমবিপিএস গতি সুবিধা দিতে পারে। তবে আশা করা হচ্ছে, এই নেটওয়ার্কেই ১ গিগাবাইট পার সেকেন্ড গতি একসময় দেয়া যাবে। চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোয়ালকম বলছে, ফাইভ-জি এর ১০ থেকে ২০ গুণ গতি দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ভালো মানের চলচ্চিত্র হয়তো মাত্র এক মিনিটেই ডাউনলোড করা যাবে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় ফাইভ-জি মোবাইল সেট ক্রেতা শিম জি-হাই বলেন, ‘আমি প্রায়ই মোবাইলে ভিডিও, সিনেমা ও লেকচার শুনে থাকি। আশা করছি, দ্রুতগতির এই নেটওয়ার্ক আমার সময় বাঁচাতে সাহায্য করবে।’ আরেক ব্যবহারকারী বলছেন, তিনি এই ফোনটির ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) কনটেন্ট নিয়েই বেশি রোমাঞ্চিত।
ফাইভ-জি প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করা নিয়ে গবেষক লি সাং-ইউন এএফপিকে বলেছেন, ‘ফাইভ-জি আসায় এখন ভিআর কনটেন্ট আরো বাস্তবভাবে, দ্রুত ও ভালো রেজল্যুশনে উপভোগ করা যাবে।’
ফাইভ-জি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট যুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে দেবে, এমন নয়। আবাসিক এবং অফিসগুলো আরো অনেক বছর ধরে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড লাইনের ওপর নির্ভর করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এখনো অনেকই মনে করেন, তারের মাধ্যমে স্থিতিশীল ইন্টারনেট পাওয়া যায়।

লন্ডনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস বলছে, ফাইভ-জি আসায় ২০৩৪ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতির লাভের খাতায় যুক্ত হতে পারে প্রায় ৫৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এতসব আলোচনার পর, আমরা নিজেদের দেশের কথা এ প্রসঙ্গে বিবেচনা করতে পারি। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই সেবা বাংলাদেশে চালু করা হবে বলে এর আগে মন্ত্রীর একটি ঘোষণা ছিল। সেখান থেকে পিছিয়ে এসে এখন বলা হচ্ছে, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ফাইভ-জি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বেসরকারি মোবাইল অপারেটর রবি এরই মধ্যেই এই সেবা দেয়ার ব্যাপারে একটি পরীক্ষা সম্পন্নও করেছে।

তবে জনগণের জন্য বাণিজ্যিকভাবে এ প্রযুক্তি চালু করতে হলে আমাদের এ সম্পর্কিত অবকাঠামো ফাইভ-জির উপযোগী করে তুলতে হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে সেটা করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে ইন্টারনেট প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন, এমন বিশেষজ্ঞদের মনেই কিছুটা দ্বিধা ও সংশয় আছে। কারণ, ২০০১ সালে সারা বিশ্বে থ্রি-জি সেবা চালু হলেও আমাদের সেটা চালু করতে সময় লেগেছিল ১১ বছর। ২০০৬ সালে চালু হওয়া ফোর-জি সেবা এ দেশে আসে ১২ বছর পর। আমরা সত্যিই ফোর-জি নেটওয়ার্কের সেবা পাচ্ছি কিনা সে প্রশ্নও আছে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেরই (বিটিআরসি) এক জরিপে বলা হয়, দেশের কোনো মোবাইল অপারেটরই চতুর্থ প্রজন্মের (ফোর-জি) ইন্টারনেট-সেবায় নির্ধারিত মাত্রার গতি দিতে পারছে না। অপারেটররা বলছেন, বিদ্যমান অবকাঠামোতে বেশি গতি দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং উন্নততর ফাইভ-জি নিয়ে অবস্থা ‘লেজে-গোবরে’ হয়ে দাঁড়ায় কিনা সেটা মাথায় রাখা দরকার।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন তরঙ্গ কেনাসহ পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হলে গ্রাহক সুবিধা বাড়বে না ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে। বিনিয়োগ যদি ঠিকমতো না হয় তাহলে এখান থেকে বিনিয়োগ রিটার্নটা যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাবে না।

এ কথা তো সত্য, যথাসময়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে না পারলেও প্রযুক্তির হাত ধরে বর্তমান বিশ্বে যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়েছে, বাংলাদেশের তা থেকে পিছিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়েও এখন থেকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করা দরকার। আশা করি, সরকারের সদিচ্ছায় আমরা প্রযুক্তির এই আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হবো না।

আরো সংবাদ