৩৮ বছর ধরে লাল ফিতায় বন্দী রয়েছে ফুলবাড়ী জেলা বাস্তবায়নের ফাইল। ফাইলটি মন্ত্রণালয়ে বন্দী থাকায় জেলা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করে আসছেন ফুলবাড়ীসহ ছয় উপজেলার বাসিন্দারা।
জানা গেছে, দিনাজপুর জেলার পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ছয় উপজেলার কেন্দ্রবিন্দু ফুলবাড়ী উপজেলাকে জেলা করার জন্য গত ১৯৮১ সালে তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদ নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়। সে সময়ে ফুলবাড়ী ও পার্বতীপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত দিনাজপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য মনসুর আলী সরকার জেলা বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য দিন-তারিখ ঠিক করেন। কিন্তু সেই শুভক্ষণ না আসতেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ায় আটকে পড়ে ফুলবাড়ী জেলা বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। ওই সময় থেকে মন্ত্রণালয়ে লাল ফিতায় বন্দী রয়েছে ফুলবাড়ী জেলা বাস্তবায়নের ফাইলটি। এর পর থেকে ফুলবাড়ীসহ ছয় উপজেলার বাসিন্দারা ফুলবাড়ী জেলা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করে আসছেন।
এই এলাকার রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা জানান, দিনাজপুর জেলার অতি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ফুলবাড়ী। এই ফুলবাড়ী উপজেলার কোল ঘেঁষে ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি, ২৫০ ও ২৭৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক দু’টি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প। এ ছাড়া ফুলবাড়ী দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করতে হয় পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, ঘোড়াঘাট, হাকিমপুর উপজেলার বাসিন্দাদের। এই উপজেলায় রয়েছে পাঁচ উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পুলিশ সুপারের কার্যালয়, টিঅ্যান্ডটি মাইক্রোওয়েব স্টেশন ও ফুলবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন। এ ছাড়াও রয়েছে ৪০ বিজিবি সদর দফতর, উপশহর কাঠামো, অডিটোরিয়াম, দিনাজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সদর দফতর ও পিডিবির ছয় উপজেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, যা ওই সময় জেলা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছিল। ফুলবাড়ী পৌরসভাটি প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। ফুলবাড়ী ফায়ার সার্ভিস স্টেশনটি ছয় উপজেলার কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এখানে রয়েছে একাধিক ভারী ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, যা এই উপজেলাসহ কয়েক উপজেলার হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান করেছে।
অন্য দিকে দেড় শ’ বছর থেকে দিনাজপুর জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন ফুলবাড়ীর সন্তানেরা। ১৮৫০ সাল থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মূল নেতৃত্বেও ছিল ফুলবাড়ী উপজেলা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৩ সালে ফুলবাড়ী উপজেলার লালপুর গ্রামের বাসিন্দা রূপ নারায়ণ অবিভক্ত ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। তার নির্বাচনী এলাকা ছিল বর্তমান পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলা। এরপর দেশ বিভক্তির পর মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ফুলবাড়ী উপজেলার রাজারামপুর গ্রামের নূরুল হুদা চৌধুরী মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (এমএনএ) নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে দিনাজপুর জেলার সংগঠক ও দিনাজপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ফুলবাড়ী পৌর এলাকার বাসিন্দা মনসুর আলী সরকার। এরপর তিনি জাগো দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ট্রেজারার নির্বাচিত হন। জাগো দল থেকে বিএনপির প্রতিষ্ঠার পর তিনি দিনাজপুরের প্রধান নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৯ সালে সাধারণ নির্বাচনে ফুলবাড়ী-পার্বতীপুর আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দিনাজপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়া ৩৮ বছর ধরে আওয়ামী লীগের দিনাজপুর জেলা কমিটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন এ আসনের সংসদ সদস্য ও সবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। তিনি বর্তমানে দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দিনাজপুর জেলা বিএনপির নির্বাচিত সিনিয়র সহসভাপতি ফুলবাড়ী পৌর এলাকার বাসিন্দা অধ্যক্ষ খুরশিদ আলম মতি।
অন্য দিকে এই উপজেলা দিনাজপুর জেলার খাদ্যশস্য ভাণ্ডার হিসেবে বহু দিন থেকেই পরিচিত। আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে এই উপজেলা দিনাজপুর জেলায় অগ্রসর উপজেলা। পৌর এলাকার মধ্যেই রয়েছে ফুলবাড়ী সরকারি কলেজ, ফুলবাড়ী শহীদ স্মৃতি আদর্শ ডিগ্রি কলেজ, ফুলবাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, ঐহিত্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুজাপুর সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়, ফুলবাড়ী জি এম পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, ফুলবাড়ী বালিকা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। এ ছাড়াও দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ফুলবাড়ী দারুস সুন্নাহ্ সিদ্দিকিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা। আরো রয়েছে পাঁচটি কলেজ, তিনটি বিএম কলেজ, তিনটি ফাজিল মাদরাসা ও ৫২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসা। ফলে এখানে জেলা বাস্তবায়ন করা হলে বাড়তি নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে না। সে ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের মানুষের জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ করা খুব সহজ হয়ে উঠবে। দিনাজপুর জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ করতে এসব উপজেলার বাসিন্দাদের অনেক দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। কারণ ঘোড়াঘাট উপজেলা সদর থেকে দিনাজপুর জেলা সদরের সড়ক পথের দূরত্ব ৯২ কিলোমিটার, হাকিমপুর উপজেলা থেকে সদর ৭০ কিলোমিটার, বিরামপুর থেকে ৫৬ কিলোমিটার, নবাবগঞ্জ থেকে ৭০ কিলোমিটার। অথচ এসব উপজেলার ফুলবাড়ী থেকে দূরত্ব মাত্র ১০-২০ কিলোমিটারের মধ্যে। এ কারণে ফুলবাড়ীসহ ছয় উপজেলার বাসিন্দারা ফুলবাড়ী জেলা বাস্তবায়নের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন।