কে এই হাকান আয়িক, কীভাবে পড়লেন এফবিআইয়ের ফাঁদে?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৯ জুন ২০২১, ২৩:৫৩, আপডেট: ০৯ জুন ২০২১, ২৩:৫৭
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল তিন বছর আগে। একজন অপরাধী দোষী সাব্যস্ত হবার পর পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছিল, তাকে যদি লঘু শাস্তি দেয়া হয় তাহলে সে এএনওএম নামে একটি কমিউনিকেশন ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেবার রাস্তা বাতলে দেবে।
সেভাবেই নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এএনওএম বা ‘এ্যানম’-এর নিয়ন্ত্রণ দখল করেছিলেন।
এর পর যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই ও অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ মিলে এই এ্যানমের মেসেজিং এ্যাপকে কাজে লাগিয়ে এমন এক ফাঁদ পেতেছিলেন-যাতে পা দিয়েছে পৃথিবীর অন্তত ১৬টি দেশের শত শত অপরাধীচক্রের সদস্য।
কেউই টের পায়নি যে তাদের সব গোপন তৎপরতার খবর সরাসরি চলে যাচ্ছে পুলিশের হাতে।
যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের ১৬টি দেশে সংঘবদ্ধ অপরাধ-চক্রের বিরুদ্ধে চালানো সেই নজিরবিহীন অভিযানে মঙ্গলবার ৮০০-রও বেশি সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে নগদ প্রায় পাঁচ কোটি ডলার পরিমাণ অর্থ এবং কয়েক টন মাদকদ্রব্য ।
এই সন্দেহভাজন অপরাধীদের ধরতে এমনভাবে এই অভিনব ‘স্টিং অপারেশনের’ পরিকল্পনা করা হয়েছিল-যাতে তারা এফবিআইয়ের তৈরি এবং পরিচালিত এ্যানম মেসেজিং এ্যাপ ব্যবহার করতে আকৃষ্ট হয়।
এর মাধ্যমে অপরাধীচক্রের লাখ লাখ গোপন বার্তা এবং অপরাধমূলক তৎপরতার তথ্য পুলিশের হাতে চলে আসে ।
এ্যানম জিনিসটা কি?
ব্যবহারকারীর দিক থেকে এ্যানম হচ্ছে হোয়াটস এ্যাপের মতোই একটা মেসেজিং এ্যাপ যাতে টেক্সট বার্তা বা ছবি পাঠানো যায়, ভিডিও কথোপকথন করা যায়।
হোয়াটসএ্যাপের মতোই এটা পুরোটাই এনক্রিপটেড অর্থাৎ এর গোপনীয়তা নিশ্চিত-ব্যবহারকারী ছাড়া কেউ এতে ঢুকতে পারবে না।
তফাৎটা হলো, এ্যানম নামের এই এ্যাপটা তৈরিই করা হয়েছে অবৈধ ব্যবহারের জন্য।
সম্প্রতি এ জাতীয় বেশ কয়েকটি মেসেজিং এ্যাপ কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছিল-যার মধ্যে ছিল ‘এনক্রোচ্যাট’ এবং ‘স্কাই গ্লোবাল’। এর পর অপরাধীচক্রের লোকেরা এ্যানমের দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়ে।
২০২১ সালের মার্চ নাগাদ এ্যানমের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় তিন হাজার। কিন্তু এনক্রোচ্যাট আর স্কাই গ্লোবাল বন্ধ হবার পর এ্যানমের গ্রাহক তিনগুণ বেড়ে যায়।
তবে এই এ্যানম কেউ চাইলেই ডাউনলোড করতে পারে না।
এটা আগে থেকেই ইনস্টল করা অবস্থায় পাওয়া যায় বিশেষ কিছু মোবাইল ফোনে-যা কিনতে হয় কালোবাজারে। এসব মোবাইলের আসল ক্রেতা হচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধী চক্রগুলো।
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছে, বিশেষভাবে তৈরি এই ফোন অতি সুরক্ষিত এবং এটা কিনতে হলে একজন পরিচিত ব্যবহারকারীর অনুমোদন দরকার হয়। ছয় মাস মেয়াদি চুক্তি করতে ব্যবহারকারীকে দিতে হয় ২০০০ ডলার পর্যন্ত।
উচ্চস্তরের অপরাধ সিন্ডিকেট ও ক্রিমিনালদের মধ্যে এই ফোন এবং মেসেজিং এ্যাপের জনপ্রিয়তা ক্রমশই বাড়ছিল।
নব্বইটি দেশে ছড়িয়েছিল এই এ্যানম
প্রথম প্রথম এ্যানমের ব্যবহার ছিল খুবই অল্প কয়েকটি দেশে কিন্তু পরে এটা ছড়িয়ে পড়ে ৯০টি দেশে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী ছিল জার্মানি, নেদারল্যাণ্ডস, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া আর সার্বিয়ায়। কিন্তু এ্যানম আসলে ছিল একটা ফাঁদ। ২০১৮ সালে আমেরিকান এবং অস্ট্রেলিয়ান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যৌথভাবে এটি তৈরি করেছিলেন।
বাইরে থেকে ব্যবহারকারীদের মনে হতো যে এ্যানমে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে তার গোপনীয়তা সব সময়ই সুরক্ষিত এবং এসব ফোনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও দুর্ভেদ্য। কিন্তু এফবিআই এবং আরো কয়েকটি দেশেই আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তারা তৈরি করেছিলেন একটি ‘মাস্টার কী’ বা গোপন চাবিকাঠি ।
এটা দিয়ে কর্মকর্তারা যে কোনো ব্যবহারকারীর অজান্তে তার সব কথাবার্তা বা কী তথ্য বিনিময় হচ্ছে তা দেখতে পারতেন এবং তা সেভ করে রাখতে পারতেন।
ট্রোজান শিল্ডের পাতা ফাঁদে পা দিলেন হাকান আয়িক
মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআই এই পরিকল্পনার নাম দিয়েছিল অপারেশন ট্রোজান শিল্ড, আর অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ একে বলতো স্পেশাল অপারেশন আয়রনসাইড।
এই দুই সংস্থার কর্মকর্তারা মিলে ২০১৮ সালে এক বৈঠক করেছিলেন, বিয়ার পান করতে করতে।
সেখানেই তারা পরিকল্পনা করেন যে এই এ্যানমকে তারা অপরাধীচক্রের মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন এবং তার মাধ্যমেই তারা কী করছে তার তথ্য সংগ্রহ করবেন।
অপরাধ জগতের যেসব লোকদের ধোঁকা দিয়ে এই এ্যানম প্রথম ব্যবহার করানো হয়েছিল-তাদের একজনের নাম হাকান আয়িক একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান।
হাকান আয়িক হচ্ছেন সেই লোকদের একজন-যার মাধ্যমে দেশে দেশে অপরাধী চক্রের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই এ্যানম। বলা যায়, তিনি নিজের অজান্তেই পুলিশকে বিপুলভাবে সাহায্য করেছেন।
এ কারণে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ হাকান আয়িকের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছে, যেন তিনি এখন নিজে থেকেই ধরা দেন।
কারণ এ অভিযানে অনিচ্ছায় হলেও তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন-তার ফলে অন্য অপরাধীদের হাতে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে।
কে এই হাকান আয়িক?
বিয়াল্লিশ বছর বয়স্ক জোসেফ হাকান আয়িক অস্ট্রেলিয়ার মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধীদের একজন।
তিনি তুর্কি অভিবাসী পিতামাতার সন্তান এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে কর্মজীবীরা থাকেন এমন একটি এলাকায় বড় হন।
এক দশকেরও বেশি সময় আগে হেরোইন পাচারের একটি চক্রের মূল হোতা হিসেবে পুলিশ তাকে চিহ্নিত করে।
এর পর হাকান আয়িক অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে পালিয়ে যান। ২০১০ সালে তাকে সাইপ্রাসে কিছু সময়ের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু জামিন পাবার পর তিনি নিরুদ্দেশ হন এবং এখনো তিনি ফেরারি।
এমাসের প্রথম দিকে অস্ট্রেলিয়ার দৈনিক সিডনি হেরাল্ড রিপোর্ট করে-হাকান আয়িক এখন ইস্তাম্বুলে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন এবং তার বিরুদ্ধে গ্যাং ও মাদক চক্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
ধরা পড়া ঠেকানোর জন্য তিনি প্লাস্টিক সার্জারি করে তার চেহারা বদলে ফেলেছেন বলেও আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা মনে করেন।
অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকরা এমন কিছু ভিডিও দেখেছেন যাতে হাকান আয়িককে তিন লাখ ডলার দামের স্পোর্টসকার চালাতে দেখা গেছে। তার হাতে ছিল হীরার আংটি।
ভিডিওতে যে গান বাজানো হচ্ছিল-তাতে তার নিজের অপরাধ-জীবনের কথা ছিল।
সন্দেহ করা হয় যে তিনি এখন একজন উচ্চ স্তরের মাদক পাচারকারী। যিনি মূলত তুরস্ক থেকে আসা মাদকের চালানগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন।
অস্ট্রেলিয়ান সংবাদমাধ্যমে তাকে ডাকা হয় ‘ফেসবুক গ্যাংস্টার’ নামে।
আয়িকের মাদকচক্রটির নাম ‘অসি কার্টেল’ বলে উল্লেখ করেছে অস্ট্রেলিয়ান সংবাদ মাধ্যম এবং ধারণা করা হয় যে প্রতিবছর তিনি অস্ট্রেলিয়ায় দেড় শ’ কোটি ডলারের মাদক চালান দেন।
ইস্তুাম্বুলের অভিজাত এলাকায় তার দু’টি বাড়ি রয়েছে এবং বিভিন্ন ব্যবসায় তিনি অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। তিনি তুরস্কে বাস করছেন হাকান রেইস নামে, এবং তার অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকত্বও ত্যাগ করেছেন তিনি।
আয়িক বিয়ে করেছেন একজন ডাচ মহিলাকে এবং তাদের দু’টি সন্তান রয়েছে।
হাকান আয়িক কীভাবে এ্যানম ব্যবহারকারী হলেন
অস্ট্রেলিয়ান কর্মকর্তারা বলছেন, আয়িক টেরই পাননি যে তিনি পুলিশের অভিযানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
হাকান আয়িককে একটি মোবাইল হ্যাণ্ডসেট সরবরাহ করেছিল পুলিশের একজন ছদ্মবেশী এজেন্ট। যাতে আগে থেকেই এ্যানম ইনস্টল করা ছিল।
এর পর আয়িক নিজে আবার তার সহযোগীদের কাছে এই এ্যানমের প্রশংসা করেন এবং তা ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করেন।
এ্যানম ব্যবহার করতে হলে কালোবাজার থেকে বিশেষ ধরনের মোবাইল হ্যান্ডসেট কিনতে হয়। যাতে এই এ্যাপটি ইনস্টল করা আছে। তা ছাড়া নিরাপত্তা ও আস্থা নিশ্চিত করার জন্য এ্যানম খুলতে হলে একজন পুরনো-ব্যবহারকারীকে একটি ‘কোড’ পাঠাতে হয় নতুন ব্যবহারকারীর কাছে। এভাবেই হাজার হাজার অপরাধীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এ্যানম।
পুলিশ বলছে, কালোবাজারে এখন প্রায় ১২ হাজার ফোন রয়েছে। যাতে এ্যানম মেসেজিং এ্যাপ আছে।
অপরাধীদের প্যান্টের পকেটে পুলিশ
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে যখনই অপরাধীরা এ্যানমে কথা বলছে, বার্তা বিনিময় করছে, মাদক পাচারের পরিকল্পনা ও তথ্য পরস্পরকে জানাচ্ছে বা কাউকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। সবকিছুই তারা তাৎক্ষণিকভাবে জেনে যাচ্ছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ কমিশনার রিস কারশ বলছেন, বলতে পারেন সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধীচক্রের লোকদের প্যান্টের পেছনের পকেটে ঢুকে বসেছিলাম আমরা।
এই নজরদারির প্রযুক্তি কাঠামোটা গড়ে তুলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান কর্মকর্তারা। এর কাজ ছিল ছিল এ্যানমের প্রতিটি ব্যবহারকারীর ফোনে ঢোকা, বার্তাগুলোর এনক্রিপশনের সুরক্ষা ভেঙে তা উদ্ধার করা এবং এফবিআইয়ের তৈরি করা একটি প্ল্যাটফর্মে তা পাঠ করা।
আঠারো মাস ধরে এ্যানম এ্যাপ ব্যবহার করে ৪৫টি ভাষায় পাঠানো দুই কোটি ৭০ লাখ বার্তা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করেন কর্মকর্তারা। কর্মকর্তারা দেখেন অসংখ্য ছবি। যাতে দেখা যাচ্ছে জাহাজে করে ফলের চালানের মধ্যে লুকানো অবস্থায় টন টন কোকেন পাঠানো হচ্ছে। টিনজাত পণ্যের মধ্যে লুকিয়ে পাঠানো হয় শত শত কিলোগ্রাম কোকেন।
কলম্বিয়া থেকে কূটনৈতিক ব্যাগে করেও মাদক চালান হচ্ছে। এমন বার্তাও দেখা গেছে।
এই অভিযানে যেসব অপরাধচক্র চিহ্নিত হয়েছে তারা ছড়িয়ে ছিল দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, ও এশিয়াসহ সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
মোট ১৭টি দেশের ৯ হাজার আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তা এ অভিযানে অংশ নিয়েছেন।
উদ্ধার করা হয়েছে আট টন কোকেন, ২২ টন গাঁজা ও চরস, দুই টন মেথাএ্যামফিটামিন ও এ্যামফিটামিন, ২৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৫টি বিলাসবহুল গাড়ি, আর নগদ চার কোটি ৮০ লাখ ডলার অর্থ এবং ক্রিপটোকারেন্সি।
১০০টি দেশে ৩০০ অপরাধ সিন্ডিকেট এ রকম ১২ হাজার ডিভাইস ব্যবহার করছিল। যার সবগুলো থেকে লাখ লাখ মেসেজ পুলিশ কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন।
অভিযানে জড়িত ছিলেন সারা বিশ্বের ৯ হাজার পুলিশ কর্মকর্তা। তারা জানতে পারেন কীভাবে অপরাধীরা মাদক ও অর্থ পাচার থেকে শুরু করে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে।
এ অভিযানের লক্ষ্য যারা ছিল তাদের মধ্যে আছে মাদকপাচারকারী চক্র এবং মাফিয়ার সাথে যুক্ত লোকেরা।
১৬টি দেশে চালানো এ অভিযানে ৮০০-রও বেশি সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, এটি অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, সারা বিশ্বের সংগঠিত অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে তারা এক বড় আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছেন।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা