ফিলিস্তিন ইসরাইল সংঘাত : জো বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতিতে কেন বড় মাথাব্যথার কারণ?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৮ মে ২০২১, ২৩:৫৩
গাজায় হামাসকে লক্ষ্য করে ইসরাইলের বিমান হামলার কারণে মধ্য প্রাচ্য ইস্যুকে জো বাইডেন তার কার্যসূচিতে অন্তত অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু তিনি মানবাধিকারের বিষয়কে যেভাবে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, সেটা ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে তিনি কতটা প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হবেন-তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইল তাদের অধিকার কতটা কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে, এই সংঘাতের মধ্যে দিয়ে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই সংঘাত আবার মনে করিয়ে দিয়েছে যে সেখানে দানা বাধা অসন্তোষের জেরে এবারের যুদ্ধ শুরু হলেও এটা আরো ব্যাপকভিত্তিক ও গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু নিয়ে লড়াই। এবং অগ্নিগর্ভ এই পরিস্থিতি একসময় থিতিয়ে গেলেও দীর্ঘদিন ধরে চলা ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের প্রশ্নে বাইডেন প্রশাসনকে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে।
আর ঠিক এই সম্ভাবনাটাই এড়াতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং তার শীর্ষ উপদেষ্টারা।
তারা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তাদের কূটনৈতিক অগ্রাধিকার এখন অন্য ক্ষেত্রে। মধ্যপ্রাচ্যে যে শান্তি উদ্যোগে আমেরিকা নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের খোড়া সেই কবর নিয়ে এ পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসন বিশেষ কথাবার্তা বলেনি। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতিতে যে রকম নির্লজ্জভাবে ইসরাইল-পন্থী মনোভাবের প্রতিফলন ছিল খুব একটা জানান না দিয়ে বদলানোর চেষ্টা করছে বাইডেন প্রশাসন।
কিন্তু সেখানে সফল হতে গেলে ফিলিস্তিনের সাথে ভেঙে পড়া সম্পর্ক মেরামতের বিষয়ে তার প্রশাসনকে মনোযোগী হতে হবে এবং ইসরাইলের সাথে দীর্ঘস্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটা সফল ও কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রতি মৌখিকভাবে তার প্রশাসনের সমর্থন প্রকাশ করতে হবে। তবে বাইডেন প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী ইসরাইল ফিলিস্তিন নিয়ে নতুন দফা আলোচনার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তাই তারা আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির মূল ফোকাস এখন চীন ইস্যুতে সরিয়ে নিয়ে বদ্ধপরিকর।
গৎ বাধা প্যাটার্ন
এই সপ্তাহে প্রশাসনের ফোকাস আবার মধ্য প্রাচ্যের দিকে ঘুরে গেছে দেশটির পররাষ্ট্র নীতির একটা গৎ বাধা প্যাটার্ন মেনে।
প্রেসিডেন্ট ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আবার আমেরিকার চিরাচরিত ভাষায় কথা বলেছেন। তারা জোর দিয়ে বলেছেন ফিলিস্তিনি রকেট হামলার মুখে ইসরাইলের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে।
ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বাড়তে থাকা ব্লিঙ্কেন উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তিনি দুই পক্ষের হামলাকারীদের মধ্যে একটা পরিষ্কার পার্থক্য রয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন একটি হল সন্ত্রাসবাদী সংগঠন যারা বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করছে এবং ইসরাইল হামলা চালাচ্ছে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে।
হামাসের দিক থেকে ছোড়া অসংখ্য ক্ষেপণাস্ত্রের জবাব দিতে ইসরাইলের পাল্টা আক্রমণকে বাইডেন খুব বাড়াবাড়ি প্রতিক্রিয়া বলে মনে করছেন না।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, তার এই যুক্তি ইসরাইলের হামলা চালানোর জন্য একটা প্রচ্ছন্ন সবুজ সঙ্কেত, যদিও আমেরিকা দু’পক্ষের প্রতিই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।
আরব গাল্ফ স্টেটস ইনস্টিটিউট-এর হুসেইন ইবিশ বলছেন, ওয়াশিংটন সবসময় প্রথমেই ইসরাইলকে এধরনের রকেট হামলা মোকাবেলায় একটা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেয় যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মনে হয় যে জঙ্গীদের অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দিতে ইসরাইলের যা করণীয় ছিল সেটা তারা যথেষ্ট পরিমাণে করার সুযোগ পেয়েছে ।
কূটনৈতিক স্তরে আবার যোগাযোগ?
বাইডেন প্রশাসন এ সপ্তাহে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়টি উত্থাপন করতে বাধা দিয়েছে এই যুক্তি দেখিয়ে যে এ সম্পর্কে কোনো বিবৃতি বা প্রকাশ্য বৈঠকের প্রসঙ্গ পর্দার আড়ালে চালানো কূটনীতির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। নিরাপত্তা পরিষদে সচরাচর ইসরাইলের বিরুদ্ধে সমালোচনা ঠেকাতে আমেরিকা একাই লড়াই করে থাকে। তবে আমেরিকা রোববার পরিষদের এক জরুরি অধিবেশনে সম্মতি দিয়েছে। তবে বাইডেন প্রশাসনকে কূটনৈতিক পর্যায়ে তাদের ভূমিকা তুলে ধরার জন্য দ্রুত মাঠে নামতে হচ্ছে।
বিশেষ করে এমন একটা সময় যখন এর জন্য তাদের পুরো কোন টিম তৈরি নেই, এমনকি ইসরাইলে রাষ্ট্রদূত হিসাবে তারা কাউকে মনোনয়নও করেনি।
ব্লিঙ্কেন ও অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইসরাইলে পররাষ্ট্র কর্মকর্তাদের সাথে ফোনে কথাবর্তা বলছেন। আরব দেশগুলোর প্রতি জরুরি আহ্বান জানানো হয়েছে যেন তারা মিশরের নেতৃত্বে আঞ্চলিকভাবে একটা পদক্ষেপের রূপরেখা তৈরিতে সাহায্য করে।
আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন বিষয়ে তার শীর্ষ কর্মকর্তা হাদি আমরকে ওই এলাকায় পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমর মধ্য-মাপের একজন কূটনীতিক। আগের প্রশাসনে যে পদমর্যাদার বিশেষ দূতরা এই দৌত্যকাজ করেছেন - তিনি পদমর্যাদায় তাদের সমকক্ষ নন।
পর্দার আড়ালে যে আসলেই কোনোরকম অর্থবহ কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যেত যদি একজন আরো সিনিয়র কাউকে এই কাজে নিযুক্ত করা হতো, বলছেন ইসরাইলে আমেরিকার সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল কুর্টৎজার।
জেরুসালেমের জন্য লাল রেখা
গাজায় বিমান হামলা বিধ্বংসী হলেও সেটা পরিচিত একটা দৃশ্য। কিন্তু জেরুসালেমের যে অসন্তোষের স্ফুলিঙ্গ থেকে এই যুদ্ধের দাবানল তৈরি হয়েছে তা নতুন।
জেরুসালেম শহরের দখল ইসরাইল নেয় ১৯৬৭ সালে। ফিলিস্তিনিরা দাবি করে শহরের পূর্বাঞ্চলটা তাদের। শহরের ওই অংশ দুই পক্ষের জন্যই পবিত্র স্থান এবং এই অংশ নিয়ে বিরোধ দীর্ঘ দিনের। শহরের এই অংশের ভবিষ্যত কী হবে সেটাই ছিল আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল বিষয়। কিন্তু ইসরাইলের দক্ষিণপন্থী সরকার এবং তাদের সাথে ইহুদি বসতিস্থাপনকারী দলগুলো ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে হঠাতে কাজ করে চলেছে। ট্রাম্প প্রশাসনও সেই তৎপরতাকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন করেছে, ফলে তা আরও প্রকাশ্য হয়েছে।
পরিস্থিতি যে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে তার কোনো সতর্ক সঙ্কেত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের টিম লক্ষ্য করেনি, বলছেন হুসেইন ইবিশ।
ইসরাইলি সরকার এবং বসতিস্থাপনকারী গোষ্ঠী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার অভিযান চালাতে সেখানে যে উস্কানিমূলক পরিস্থিতি তৈরি করেছে তা ঠেকাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
বসতিস্থাপনকারীরা বেশ কিছু ফিলিস্তিনি পরিবারকে উৎখাত করার অভিযান চালালে একের পর এক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। এরপর আল-আকসা মসজিদে রমজানের সময় ইসরাইলি পুলিশের বাড়াবাড়ি ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভকে আরো বাড়িয়েছে, পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তুলেছে।
যে পাহাড়ের ওপর আল-আকসা মসজিদ অবস্থিত তা ইহুদি এবং মুসলমান উভয়ের জন্যই পবিত্র স্থান।
মুসলিম এলাকার মধ্যে দিয়ে ডানপন্থী ইহুদি জাতীয়তাবাদীদের মিছিলের পরিকল্পনাও ক্ষোভে আরও ইন্ধন যুগিয়েছে, যদিও সেই পরিকল্পনা শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়।
এই ঘটনার জেরে ইসরাইলের ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভুত নাগরিকদের মধ্যেও প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে এবং এর ফলে ইসরাইলের যেসব শহরে আরব ও ইহুদি জনগোষ্ঠী একসাথে বসবাস করে সেখানে প্রতিবাদ উদ্বেগজনক দাঙ্গায় রূপ নেয়, যা ছিল নজিরবিহীন।
বাইডেন প্রশাসনের উচিত জেরুসালেমে লাল রেখা টেনে দেয়া, বলছেন ড্যানিয়েল কুর্টৎজার।
তাদের ইসরাইলি সরকারকে বলতে হবে এখানে থামতে হবে। আর বেশিদূর যাওয়া যাবে না। পূর্ব জেরুসালেমে উস্কানিমূলক কোনো কাজের জন্য সীমা বেধে দিতে হবে।
তিনি বলছেন, তাদের বলতে হবে আমরা ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করি, কিন্তু এ ধরনের কাজ বন্ধ করতে হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর দু’পক্ষকেই জেরুসালেমে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল। তবে এরপরই হামাসের রকেট আক্রমণ আমেরিকার সুর বদলে দেয়।
ব্লিঙ্কেন বলেন, ইসরাইলের রাস্তায় সহিংসতা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন, বলছেন ইবিশ। কিন্তু তখনও তীব্র এই লড়াই শুরু হয়নি।
মানবাধিকার প্রশ্নে অবস্থান?
বাইডেন প্রশাসন বার্তা দিয়ে এসেছে যে, তাদের পররাষ্ট্র নীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। এটা এই প্রশাসনের জন্য আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে, কারণ ইসরাইল, গাজা এবং পশ্চিম তীরে তারা এই মূল্যবোধ সমানভাবে প্রয়োগ করতে কি সমর্থ হবে?
সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলোতে ব্লিঙ্কেন বারবার বলেছেন ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিদের স্বাধীনতা, সম্মানবোধ, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি সর্ব ক্ষেত্রে সমান অধিকার পাওয়া উচিত ।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের খালেদ এল গিনডি বলছেন, তাদের এই ফর্মূলা নতুন ও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু একইসাথে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। এটা কি বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবং বর্তমান সময়ে প্রযোজ্য? তিনি প্রশ্ন তুলছেন। নাকি এটা যখন দুই রাষ্ট্রের ভবিষ্যত অবস্থান চূড়ান্ত হবে তখন প্রযোজ্য হবে? এটা বর্তমানে কার্যকর নয়, কাজেই আমরা জানিনা এটা কখন কীভাবে প্রয়োগ করার ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। আসলেই আমরা জানি না।
এই চারটি মূল্যবোধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক অসমতা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বামপন্থীরা দেখেছেন বলে বলছেন, তা নিয়ে তাদের মধ্যে সমালোচনা বাড়ছে। তবে রাজনীতিতে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির কী প্রভাব পড়বে তা স্পষ্ট নয়। নতুন এই আইন প্রণেতারা, যারা দলের ইসরাইল-পন্থী মতাদর্শের বিরুদ্ধে, তারা হয়ত বাইডেনকে চ্যালেঞ্জ করবেন না। তবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ড ব্যবহারের ব্যাপারে তারা যে অন্তত চাপ দিচ্ছেন সেটা দেখা যাচ্ছে।
ইসরাইলের জন্য সামরিক খাতে বরাদ্দ ৩.৮ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক সহায়তাকে এই কাজে একটা দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করার আহ্বান তারা প্রশাসনের প্রতি জানাচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার হাউসে ভাষণ দেবার সময় এরা কেউ কেউ এটাকে একটা গোষ্ঠীর প্রতি ন্যায় বিচারের ইস্যু হিসাবে তুলে ধরেছেন।
কুর্টৎজার বলছেন, বাইডেন প্রশাসন চাইবে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে বর্তমান এই লড়াই শেষ হয়ে যাক, জেরুসালেমের পরিস্থিতি যেটাকে স্বাভাবিক বলে সাধারণ সময়ে ধরে নেয়া হয়, সেই অবস্থা ফিরে আসুক। তারপর তারা কী করণীয় তা নিয়ে ভাববেন। তবে গাজার উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে এ সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বাইরে ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভ করেছে। তাদের সমাবেশ থেকে উচ্চকিত স্লোগান উঠেছে নো জাস্টিস-নো পিস (বিচার নেই-শান্তি নেই) ।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এই স্লোগান অব্যাহত থাকলে ইসরাইল ফিলিস্তিন সঙ্কটকে বাইডেন প্রশাসন বেশি দিন দূরে ঠেলে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা