ট্রাম্প কি কোনো কৌশল করছেন, নাকি রাজনীতি থেকে বিদায় নেবেন?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৩৫, আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১৭:১০
জো বাইডেন যে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট তা নিশ্চিত হওয়া গেছে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে। যেখানে বাইডেন পেয়েছেন ৩০৬ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট, সেখানে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২৩২টি। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানদের নেতা মিচ ম্যাককোনেল নিরবতা ভেঙে অভিনন্দন জানিয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনকে। এতদিন চুপ থাকা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও অভিনন্দন জানিয়েছেন। তবে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের পর এখনো চুপ করে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাহলে ট্রাম্প কী কোনো কৌশল করছেন, নাকি রাজনীতি থেকে বিদায় নেবেন?
এ দিকে ট্রাম্প এখনো পরাজয় স্বীকার করেননি, বরং নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এই অভিযোগে করা তার মামলাগুলো বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে একের পর এক খারিজ হয়ে গেছে।
তবে ট্রাম্প শিবির বলছে, আইনী লড়াই চলতে থাকবে। তারা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবেন।
যদিও সুপ্রিম কোর্টে এরকম কোনো আপিল শোনা হবে কি না এবং নির্বাচনী ফল উল্টে দিতে পারবে কি না- তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাহলে কী ট্রাম্পের হাতে আরো চার বছর হোয়াইট হাউসে থেকে যাবার কোনো কৌশল এখনো রয়ে গেছে?
তবে ট্রাম্পের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও অনুগতদের একটি দল এখনো মনে করছেন- একটি পথ আছে। ওই নাটক মঞ্চস্থ হবে ৬ জানুয়ারি।
কী ঘটতে যাচ্ছে ৬ জানুয়ারি?
সোমবার ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের যে ফল জানা গেছে, তা এখনো ‘আনুষ্ঠানিক’ ফল নয়।
এই ভোটের ফল পাঠানো হবে ফেডারেল রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। পরে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশনে ইলেকটোরাল ভোট আনুষ্ঠানিকভাবে গণনা করা হবে আগামী ৬ জানুয়ারি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬ জানুয়ারির ঘটনাবলী হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোটের ফল উল্টে দেয়ার ক্ষেত্রে ‘শেষ সুযোগ’ এনে দিতে পারে। এরকম একটা প্রয়াস নিচ্ছেন কয়েকজন সিনেটর এবং কংগ্রেস সদস্য। আরিজোনা, পেনসিলভেনিয়া, নেভাডা, জর্জিয়া ও উইসকন্সিনে অবৈধ ও ভোট জালিয়াতির লিখিত অভিযোগ জমা দেবেন তারা। ওই লিখিত অভিযোগে থাকবে অন্তত একজন সিনেটরের স্বাক্ষর। এর লক্ষ্য হবে ওই অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোট ‘ডিসকোয়ালিফাই’ বা বাতিল করা।
আলাবামা অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান সিনেটর মো ব্রূকস মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলছেন, মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী ওই দিন (৬ জানুয়ারি) সুপ্রিম কোর্টসহ যেকোনো আদালতের বিচারকের চেয়ে বড় ভূমিকায় থাকবে কংগ্রেস সদস্যরা। ‘ওই দিন আমরা যা বলবো তাই হবে, সেটাই চূড়ান্ত’।
এ ধরণের অভিযোগ উঠলে ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ফলাফল প্রত্যয়ন করতে অস্বীকার করলে কী হবে- তা নিয়ে মার্কিন বিশ্লেষকরা নানা রকম চিত্র তুলে ধরছেন।
মো ব্রূকস বলছেন, ‘আমার এক নম্বর লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থা- যা ভোটার জালিয়াতি বা ভোট চুরিকে খুব সহজে মেনে নিচ্ছে- তা মেরামত করা। আর এটা থেকে একটা বোনাস মিলে যেতে পারে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেকটোরাল ভোটে আনুষ্ঠানিকভাবে জিতে গেলেন। কারণ আপনি যদি অবৈধ ভোটগুলো বাদ দেন এবং যোগ্য মার্কিন নাগরিকদের আইনসঙ্গত ভোটগুলোই শুধু গণনা করেন তাহলে তিনিই জিতেছেন। কিন্তু এরকম কোনো প্রক্রিয়া হবে জটিল ও দীর্ঘ ।’
প্রতিটি অভিযোগ নিয়ে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে দু’ঘণ্টা করে বিতর্ক এবং ভোটাভুটি হতে হবে। কোনো একটা অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট বাতিল করতে হলে ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ ও রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত সিনেটকে একমত হতে হবে। তবে উনবিংশ শতাব্দীর পর কখনো এমনটা হয়নি।
যদিও অনুমান করা যায়, ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ভোট বাতিলের চেষ্টা অনুমোদন করবে না। তা ছাড়া রিপাবলিকান কয়েকজন সেনেটরও এভাবে ভোট বাতিলের প্রয়াস জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা এ চেষ্টার বিপক্ষে ভোট দিলেই জো বাইডেনের জয় নিশ্চিত হয়ে যাবে।
ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের ওই অধিবেশনে সভাপতি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। কারণ তিনিই সাংবিধানিক দায়িত্ব অনুযায়ী ৫০টি অঙ্গরাজ্য থেকে পাঠানো ইলেকটোরাল ভোটের খামগুলো খুলবেন ও ওইগুলোর যোগফল ঘোষণা করবেন।
১৯৬০ সালে রিচার্ড নিক্সন ও ২০০০ সালে এ্যাল গোরকে এভাবেই ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে তাদের নিজেদের পরাজয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর বিজয়কে প্রত্যয়ন করতে হয়েছিল। তারা এটা করতে গিয়ে তাদের নিজেদের দলের আইনপ্রণেতাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করেছিলেন।
মাইক পেন্সও কী তাই করবেন?
বারাক ওবামার সময়ের হোয়াইট হাউজের আইনজীবী গ্রেগরি বি ক্রেইগ বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট যে ভূমিকা পালন করেন তার প্রতি এতদিন মানুষ কোনো দৃষ্টি দেয়নি। এটা নিয়ে ভাবেওনি। কিন্তু যেহেতু প্রেসিডেন্ট এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প- তাই আপনাকে সব সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখতে হবে’।
পেন্সের সামনে উভয়-সঙ্কট?
এতদিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেন্স এক দিকে যেমন ট্রাম্পের বিশ্বস্ত ছিলেন, তেমনি তিনি আইনও মেনে চলেছেন। নির্বাচনের পর থেকে পেন্স ট্রাম্পকে সাহায্য করার ব্যাপারে মিশ্র বার্তা দিয়ে চলেছেন।
প্রথম দিকে তিনি ভোট জালিয়াতির দাবিগুলো সমর্থন করার জন্য ট্রাম্প সমর্থকদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোর ভোট বাতিল করার জন্য টেক্সাসের এ্যাটর্নি জেনারেলের করা মামলার প্রশংসা করেছেন, যদিও আদালতে ওই মামলা খারিজ হয়ে গেছে।
সমস্যার বিষয় হলো, পেন্স নিজেই নাকি ২০২৪ সালে রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে চান।
তার সামনে সঙ্কট : তিনি কি এ নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিয়ে বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে তার নিজের দলের ভোটারদের বিরাগভাজন হবার ঝুঁকি নেবেন? নাকি ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে একটা সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিতে রিপাবলিকানদের বাধ্য করবেন?
সম্ভাবনা ‘শূন্য’
ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক এডওয়ার্ড বি ফোলি নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলছেন, যত আপত্তি, মামলা বা অভিযোগই থাকুক- তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারবে না।
তিনি বলেন, ‘৬ জানুয়ারির কংগ্রেস অধিবেশনে তা নিশ্চিত হয়ে যাবে, এটা আমরা স্পষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি’।
বিবিসির বিশ্লেষক এ্যান্টনি যুর্কার বলছেন, ‘প্রতিনিধি পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করছেন ডেমোক্র্যাটরা। ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের ফলাফল অঙ্গরাজ্যগুলো প্রত্যয়ন করে দিয়েছে। ফেডারেল আইনও এখন বাইডেনের পক্ষে। তাই ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনের ফল উল্টে দেয়ার চেষ্টায় সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা এখন শূন্য।’
ট্রাম্প কী এরপর রাজনীতি থেকে বিদায় নেবেন?
এখন মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড্র ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস ছাড়তে হবে। কিন্তু তার সাথেই কি মার্কিন রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে ট্রাম্পের প্রস্থান ঘটবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, হয়তো না।
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে পিটার বেকার ও ম্যাগি হেবারম্যান লিখেছেন, হয়তো দেখা যেতে পারে যে ট্রাম্পের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। হয়তো তিনি মার্কিন রাজনীতিতে একটি জোরালো শক্তি হিসেবে রয়ে যেতে পারেন, যার মোকাবিলা করা কঠিন হতে পারে।
এমন ধারণার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় সাত কোটির কাছাকাছি ভোটারের ভোট পেয়েছেন। যা ২০১৬ সালে তিনি যে ভোট পেয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি।
দেখা যায়, পপুলার ভোটের প্রায় ৪৮ শতাংশ পেয়েছেন ট্রাম্প। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর অর্থ হলো চার বছর ধরে তাকে নিয়ে নানা রকম কেলেংকারি, রাজনৈতিক বিপর্যয়, অভিশংসন ও করোনাভাইরাস এই সবকিছু সত্বেও তার পক্ষে আছে আমেরিকান জনগণের প্রায় অর্ধেকের সমর্থন।
এর আগে এক মেয়াদ পরই ভোটে হেরেছিলেন এমন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডেমোক্র্যাট জিমি কার্টার ও রিপাবলিক জর্জ এইচ বুশ সিনিয়র। তাদের কারোরই ভোটের সংখ্যার বিচারে ট্রাম্পের মতো ক্ষমতার ভিত্তি ছিল না।
ট্রাম্প তার ঘনিষ্ঠ মহলে নিজের একটি টিভি নেটওয়ার্ক চালু করার কথা বলেছেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে ফক্স নিউজের সাথে পাল্লা দেয়া। তা ছাড়া ২০২৪ সালে আবার প্রার্থী হবার আভাসও দিয়েছেন ট্রাম্প, যদিও তখন তার বয়স হবে ৭৮। আর নির্বাচনে তিনি যদি আবার প্রার্থী না-ও হন, তাহলেও টুইটারে তার ৮৮ মিলিয়ন ফলোয়ার তো আছেন। ফলে এমন হতে পারে যে আমেরিকার দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে তিনি হয়ে উঠতে পারেন এক অত্যন্ত প্রভাবশালী কণ্ঠ।
হয়তো এ কারণেই রিপাবলিকান মহলে পরবর্তী তারকা কে বা কারা হবেন তা নির্ধারণে ট্রাম্পের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। হয়তো এটা মাথায় রেখেই ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পরপর সাবেক অ্যারিজোনা সিনেটর জেফ ফ্লেক বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের ফল থেকে এটা পরিষ্কার যে ট্রাম্পের বিপুল জনসমর্থন আছে এবং তার এখনই মঞ্চ ছেড়ে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই।’
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ট্রাম্পের ভূমিকা বাইডেন প্রেসিডেন্ট হবার পরও থাকবে, তবে এমন ধারণার সাথে সবাই একমত নয়।
সাবেক কংগ্রেস সদস্য ফ্লোরিডার কার্লোস কারবেলো বলছেন, ‘আমরা আর কখনোই আরেকটি ডোনাল্ড ট্রাম্প দেখতে পাবো না। তার নকল কেউ বেরুলেও তারা ব্যর্থ হবে এবং ট্রাম্প নিজেও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তার শাসনকাল যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে তার ক্ষতচিহ্ন হয়তো কোনোদিনই মুছবে না।’
তবে এটা সত্যি যে জেরাল্ড ফোর্ড, জিমি কার্টার বা জর্জ এইচ বুশ- যারা এক মেয়াদ পরেই হোয়াইট হাউস থেকে উৎখাত হয়েছেন- তারা কেউ কেউ চেষ্টা করলেও, রাজনীতির মঞ্চে আর ফিরে আসতে পারেননি।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা