চিকিৎসা সুরক্ষা উপকরণ নিয়ে শঙ্কা
- মাহমুদুল হাসান
- ১৭ মার্চ ২০২০, ০০:০০
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকদের দম ফেলার সময় নেই এখন। সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশেও চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টসহ হাসপাতাল কর্মীরা সাধ্যমতো প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেই সাথে ভয়-উৎকণ্ঠাও জেঁকে বসছে অনেকের মধ্যে। কারণ হাসপাতালে বেড ও আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি থাকলেও ঘাটতি রয়েছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণের।
রাজধানী ঢাকার চিকিৎসক, সিভিল সার্জন ও দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে হাসপাতালে গঠিত হয়েছে ‘রেসপন্স টিম’। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজটিও সম্পন্ন করেছে সরকার। চিকিৎসকরাও মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু এ চিকিৎসায় যেসব সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে, তার পর্যাপ্ত মজুদ নেই, সরকারের এত আয়োজনের মধ্যেও যা শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, আগে থেকেই এ বিষয়ে আরো গুরুত্ব দেয়ার দরকার ছিল। না হয় সবারই পরিবার আছে, সুরক্ষা উপকরণের সঙ্কট থাকলে অনেক চিকিৎসক সেবা দিতে অপারগতা প্রকাশ করতে পারেন। এ ছাড়া পারিবারিকভাবেও বাধা আসতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।
সুরক্ষা উপকরণের ঘাটতির কথাটি স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস বড় আকারে এলে আগামী তিন মাসের জন্যও পর্যাপ্ত উপকরণ আমাদের মজুদ নেই। তবে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। আমরা এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আমাদের অন্য উন্নয়ন অংশীদারের সাথে কথা বলেছি। তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে দেশেই এসব পণ্যের উৎপাদন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত এমবিবিএস চিকিৎসকের সংখ্যা এক লাখ ৯৮৭ জন। বিডিএস পাস করা চিকিৎসক ১০ হাজার ৪৪১ এবং নিবন্ধিত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট আছেন ১৬ হাজার ৬০৪ জন। অন্য দিকে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার আরো বড় একটি অংশীদার নিবন্ধিত নার্স আছেন ৬৫ হাজার ৭৩৪ জন। এ ছাড়া সহকারী নার্স, এমসিএইচ ভিজিটরস, জুনিয়র মিডওয়াইফারি, জুনিয়র নার্স কমিউনিটি প্যারামেডিকস ও সমমানের স্টাফ আছেন ৫০ হাজার ৫৪২ জন। স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০১৮ অনুযায়ী, এদের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হয়ে সরকারিভাবে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত আছেন ২০ হাজার ৯১৪ চিকিৎসক। প্রথম শ্রেণীর এসব চিকিৎসক সরকারের বিভিন্ন দফতর, সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে কর্মরত। এছাড়া সরকারি হাসপাতালগুলোয় কাজ করেন পাঁচ হাজার ১৮৪ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ও ২০ হাজার ১০৩ জন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার। এর বাইরে বড় সংখ্যক চিকিৎসক ও সাপোর্ট স্টাফ বেসরকারিভাবে নিয়োজিত আছেন। স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত এসব চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা উপাদান না থাকাটা উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করেন চিকিৎসক নেতারা।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা: এম ইকবাল আর্সলান এ প্রসঙ্গে বলেন, অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধে নামিয়ে দেয়াটা আত্মঘাতী হতে পারে। একজন চিকিৎসক হিসেবে যদি বলি, তা হলে সুরক্ষা উপকরণের স্বল্পতা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। যদি সেবাপ্রদানকারীদের যথাযথ সুরক্ষা দেয়া না হয়, তখন সরকারের এত প্রস্তুতি বিলীন হয়ে যেতে পারে।
তার ভাষায়, এমনিতেই চিকিৎসকদের পারিবারিক চাপ আছে, এর মধ্যে জোর করে কাউকে সুইসাইড করতে পাঠানো যায় না। তবে বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সাধ্যমতো কাজ করছে এবং দ্রুত এ সমস্যা সমাধান হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদান করার জন্য একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে (চিকিৎসক ও অন্যান্য সেবাপ্রদানকারী) অবশ্যই মেডিক্যাল মাস্ক, বিশেষায়িত গাউন, হাতের গ্লাভস, চোখের জন্য গোগলস ছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষ এন৯৫ মাস্ক বা সমজাতীয় সুরক্ষা উপকরণের সঙ্গে অ্যাপ্রোণ ব্যবহার করতে হবে।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোড মেনে এ-জাতীয় উপকরণ উৎপাদন করে এমন প্রতিষ্ঠান একেবারে কম। ফলে এসব সুরক্ষা উপকরণের জন্য আমাদের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ দেশে করোনা সংক্রমণ হওয়ায় এ মূহূর্তে কেউই এসব পণ্য রফতানি করছে না। এ ছাড়া এ-জাতীয় পণ্যের সবচেয়ে বড় কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ চীন ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় উৎপাদনে সীমাবদ্ধতাও দেখা যাচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে সুরক্ষা উপকরণের মজুদ বাড়ানোর জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা পাওয়ার পর থেকে দিন-রাত কাজ করে সুরক্ষা উপকরণ তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে সরকারের কাছে উৎপাদিত সুরক্ষা উপকরণ পণ্যর একটি চালান প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ শুরু করেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা: মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমাদের কাছে অনেক বেশি সুরক্ষা উপকরণ নেই এটা সত্য। এর মধ্যে যা আছে তা থেকে হাসপাতালগুলোয় কিছু উপকরণ দিয়ে রেখেছি। বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়া পাঁচ রোগীর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, একটা রোগীর সেবা করতেই বেশ কিছুসংখ্যক সুরক্ষা উপকরণের ব্যবহার করতে হয়। তবে এখনই ঢাকার বাইরে সুরক্ষা উপকরণ মজুদের প্রয়োজনীয়তা কম বলে মনে করেন আইইডিসিআর পরিচালক।