২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শুধু আশ্বাসেই কেটে গেছে বছর

-

পুরান ঢাকার চকবাজারে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে ‘এম আর টেলিকম সেন্টার’ নামে ফ্লেক্সিলোডের দোকান চালাতেন মাসুদ আর মাহবুব। দুই ছেলের এই ছবিটিই এখন মালেকা বেগমের একমাত্র অবলম্বন। তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন মাসুদ রানা, আর মাহবুবুর রাহমান রাজু মেজো। বোনের বিয়ে হয়েছে। আর ছোট ভাই লেখাপড়া করছে। তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা দু’জনই শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে আক্রান্ত। বাবার হার্টে রিং পরানো। এই পরিবারে আরো আছেন মাসুদ ও মাহবুবের দুই স্ত্রী এবং তাদের দুই শিশুসন্তান।
দুই ভাইয়ের রোজগারেই চলত এতগুলো মানুষের এ পরিবারটি। কিন্তু সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায় গত বছরের ২০ ফেব্র“য়ারি রাতে। রাত ১০টা ৩২ মিনিটে ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুন লাগলে দোকান থেকে বের হয়ে মাসুদ আর মাহবুব দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের গলিতে। সেখানেই অনেকের সাথে দম বন্ধ হয়ে মারা যান এই দুই ভাই।
মাসুদ ও মাহবুবের দুই শিশুসন্তান। গতকাল উর্দু রোডের বাসায় কথা হয় মাসুদ আর মাহবুবের বৃদ্ধ মা মালেকা বেগমের সাথে। ভয়াবহ সেই আগুনের ঘটনা স্মরণ করে মালেকা বেগম বলেন, ‘আমার পোলারা বাইর হইবার পথ পায় নাই। পেছনের গেইট ছিল, সেই গেইটও তালা মারা ছিল। ওই গলিতে যত মানুষ ছিল, সবাই নিঃশ্বাস না নিতে পারায় মাইরা গেছে। পরদিন সকালে সবাইকে পোড়া, গলা পাওয়া গেছিল। আমার পোলাগো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাইছিলাম। ওরাতো আগুনে পুড়ে নাই। নিঃশ্বাস আটকে মইরা গেছে!’
এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। প্রাণ হারান ১২৩ জন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পুরান ঢাকার এসব কেমিক্যাল কারখানা দ্রুত সরিয়ে নেয়া হবে। গত বছরের ২০ ফেব্র“য়ারি একই অঞ্চলের চুড়িহাট্টায় পারফিউমের কারখানা ও গোডাউনে অগ্নিদুর্ঘটনায় ফের প্রাণ হারান আরো ৭১ জন। এবারো সরকার বলেছিল, পুরান ঢাকায় কোনো কেমিক্যাল কারখানা থাকবে না। কারণ এই কেমিক্যালের গুদাম পুরান ঢাকাকে মৃত্যুকূপে পরিণত করেছে। কিন্তু ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর দাহ্য এসব কারখানা সরেনি। এখনো মৃত্যুর সাথে বাজি রেখে বসবাস করছেন পুরান ঢাকাবাসী।
সরকারের পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে, একসাথে সারানো হবে এসব ঝুঁঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে আধুনিক কেমিক্যাল শিল্প পার্ক গড়ে তোলা হবে। সে জন্য চলছে জমি অধিগ্রহণ। তিন বছরের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ব্যয় হবে এক হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি বছর টঙ্গী ও শ্যামপুরে শতাধিক কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়া হবে।
গত বছরের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের বিভীষিকার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল কারখানা দ্রুত স্থানান্তরের নির্দেশনা দেন। এরপর দুর্ঘটনা রোধে কেমিক্যাল, প্রসাধনী ও প্লাস্টিকের গোডাউন ও কারখানা স্থানান্তরে বড় উদ্যোগ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। এক দশক আগে আবাসিক এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরাতে একটি পল্লী নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই সরকার একসাথে সব সরাতে ছোট পল্লী নয়, এখন বৃহৎ শিল্প পার্ক নির্মাণ করছে। যাতে পরিকল্পিতভাবে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারেন। এ জন্য মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণ হচ্ছে। জমি অধিগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পুরান ঢাকার এই মৃত্যুকূপ থেকে নিরাপদে থাকতে চান সবাই। এ জন্য পরিকল্পিত শিল্পনগরীতে যেতে সম্মত উদ্যোক্তারাও।
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর গত বছরের ২৮ ফেব্র“য়ারি থেকে পুরান ঢাকায় অভিযান শুরু করে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। ওই সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয় কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের আগে সাময়িকভাবে গোডাউন সরাতে দু’টি প্রকল্প নেয়। বিসিআইসির শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জায়গা এবং টঙ্গীতে বিএসইসির জমিতে এসব গোডাউন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী এক বছরে এ কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এখনো হয়নি।
এর আগে নিমতলীতে ট্র্যাজেডির পর বুড়িগঙ্গার ওপারে ৫০ একর জমিতে কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা মৌজায় কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের এ প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। কিন্তু সে প্রকল্প এগোয়নি। এর পরে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ৯ বছর আগে নেয়া কেমিক্যাল পল্লী প্রকল্প থেকে সরে এসে গত বছরের ১০ জুন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩০৮ একর জমিতে কেমিক্যাল শিল্প পার্ক স্থাপনের প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়। ইতোমধ্যে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দ্রুত মাটি ভরাটের জন্য দরপত্র দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, এ পার্কের একপাশে ঢাকা-দোহার সড়ক এবং অন্য পাশে ইছামতী নদী। আগামী মে মাসের মধ্যে মাটি ভরাটের কাজ শেষ হবে। এরপর অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করা হবে। এ শিল্প পার্কে প্রায় আড়াই হাজার প্লট করা হবে। এসব প্লট উদ্যোক্তারা অনেক কম দামে পাবেন। প্লটের টাকা পাঁচ থেকে ১০ বছর মেয়াদে পরিশোধের সুযোগ দেয়া হবে। এতে পুরান ঢাকা থেকে একসাথে সব গোডাউন ও কারখানা সরানো যাবে। আগামী তিন বছরের মধ্যে সব অবকাঠামো উন্নয়ন করে উদ্যোক্তাদের প্লট বুঝিয়ে দেয়া হবে। এখানে ফায়ার সার্ভিস ও নিরাপত্তার জন্য আলাদা অফিস স্থাপন করা হবে। তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপন করা হবে। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি নৌপথে পণ্য পরিবহনের জন্য পাশের নদীতে দু’টি জেটি নির্মাণ করা হবে। এটি হবে অত্যাধুনিক একটি শিল্প পার্ক।
টঙ্গীতে কেমিক্যাল গোডাউন নির্মাণ করছে বাংলাদেশ স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। এ প্রকল্পের পরিচালক ও ঢাকা স্টিল ওয়ার্কসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান খান বলেন, দুই ধাপে এই গোডাউন নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করছে নারায়ণগঞ্জ ড্রাইডক ইঞ্জিনিয়ারিং। তিনি বলেন, প্রথম ধাপে সাতটি গোডাউন হবে। দ্বিতীয় ধাপে একটি আটতলা ভবন করা হবে। ওই ভবনে ৪৮টি গোডাউন হবে। এ বছরের জুলাই মাসের মধ্যে প্রথম ধাপের গোডাউন হস্তান্তর করা হবে। দ্বিতীয় দফার কাজ এক বছরে শেষ হবে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের উদ্যোগে শ্যামপুরের ৫৪টি কেমিক্যাল গোডাউন নির্মাণ হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, গত ডিসেম্বরে গোডাউন নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। সব একতলা গোডাউন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া দু’টি অফিস ভবন নির্মাণ করা হবে। এখানে দুর্ঘটনা ঝুঁকি এড়াতে এক লাখ গ্যালন পানির ওভারহেড ট্যাংক নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উদ্যোক্তাদের গোডাউন হস্তান্তর করা হবে। তিনি বলেন, গোডাউন নির্মিত হলে বিসিআইসি ভাড়ার নীতিমালা তৈরি করবে। এরপর বৈধ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দেয়া হবে।
গতকাল পুরান ঢাকায় গিয়ে দেখা যায়, আবাসিক ভবনে সেই কেমিক্যাল গোডাউন, ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা, সরু গলিতে ভিড় ঠেলে দাহ্য পদার্থ আনা-নেয়াসহ সব কিছুই চলছে আগের মতোই। কেমিক্যাল নামের ‘বোমা’র ওপরই বসবাস করছেন বাসিন্দারা। ঘনবসতি ও ঝুঁকিপূর্ণ পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য পদার্থ অপসারণ না হওয়ায় এখনো আতঙ্কে রয়েছেন বাসিন্দারা।
গত বছরের ২০ ফেব্র“য়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের কেমিক্যালের গোডাউন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে সে সময় গঠিত একাধিক সংস্থা তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন সুপারিশ দিয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলÑ দাহ্য পদার্থের গোডাউন সরানোর ব্যবস্থা করা, কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা, সরু রাস্তা মানুষ ও যানবাহন চলাচলে অযোগ্য হওয়ায় বাসিন্দাদের পর্যায়ক্রমে অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়া, পুরান ঢাকাকে পরিকল্পিত নগরায়নের আওতায় নেয়া; গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও পানির লাইনের জন্য আলাদা আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করা, কেমিক্যাল ব্যবহার এবং সংরক্ষণের সাথে সংশ্লিষ্টদের ঝুঁকি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া ইত্যাদি। কিন্তু ঘটনার এক বছর হয়ে গেলেও বাস্তবায়ন হয়নি কোনো কিছুই। এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ঘুম ভেঙে ছিল প্রশাসনের। কেমিক্যাল গোডাউনের বিরুদ্ধে দৌড়ঝাঁপ হয়েছিল বেশ কিছু দিন। সেটিও থেমে যায় কিছু দিন পর।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো নড়েচড়ে বসে। কমিটি হয়, মিটিং হয় দফায় দফায়, সিদ্ধান্তও হয় অনেক। কিন্তু সেসব আর বাস্তবায়ন হয় না। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পরও অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সব উদ্যোগ থেমে গেছে।
ছবি : আর্কাইভ


আরো সংবাদ



premium cement
১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করবে অস্ট্রেলিয়া ‘জুলাই বিপ্লবে আহতদের চিকিৎসায় অবহেলা বরদাস্ত করা হবে না’ মার্কিন শ্রম প্রতিনিধিদল আসছে শুক্রবার ৬ ঘণ্টা অবরোধের পর মহাখালীর সড়ক ও রেললাইন ছাড়লেন রিকশাচালকরা দেশে ফিরেছেন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান নওগাঁয় পৃথক স্থান থেকে ২ জনের লাশ উদ্ধার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রাসিকের ১৬১ কর্মীর অব্যাহতি, ৩৮ জনকে শোকজ খালাস পেলেন সোহেল-টুকুসহ বিএনপির ২২ নেতাকর্মী পল্লী বিদ্যুতের সঙ্কট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান হেফাজত আমিরের ঢাকায় ব্যাটারিচালিতরিকশা বন্ধ করা কতটা কঠিন?

সকল