মশা নিয়ন্ত্রণে আগেভাগে প্রস্তুত, তবে!
- মাহমুদুল হাসান
- ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
আগের বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে চায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তাই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে এবার আগেভাগে প্রস্তুতি ও কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থা দু’টি। ইতোমধ্যে পুরো বছরের মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মশকনিধনের বছরব্যাপী এই কর্মপরিকল্পনা স্থানীয় সরকার বিভাগে জমা দিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তাতে ডেঙ্গুর প্রাক-মৌসুম, মূল-মৌসুম এবং মৌসুম-পরবর্তী পরিকল্পনা আছে।
দুই সংস্থার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, কর্মপরিকল্পনায় এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে কীটতত্ত্ববিদদের সহায়তায় জরিপ চালানো হবে। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। দুই সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে মাঠপর্যায়ে মশকনিধন কার্যক্রম পরিদর্শন, তদারকির জন্য ‘মশকনিধন সেল’ গঠন করা হবে।
সিটি করপোরেশনের বছরব্যাপী মশকনিধন কর্মপরিকল্পনা থাকাকে ইতিবাচক বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, শুধু পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
দুই সিটি করপোরেশনের কর্মপরিকল্পনায় মশার অন্যতম প্রজননস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস ডিপো, থানায় রাখা পুরনো গাড়ি, সিভিল এভিয়েশনের আওতাধীন এলাকা, নির্মাণাধীন ভবন, জমে থাকা পুরনো টায়ারকে। এসব জায়গায় মশার প্রজনন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব, ঢাকা মহানগর পুলিশ, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, টায়ার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাথে সমন্বয় সভা করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
চলতি মাসে স্থানীয় সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে আঞ্চলিক পরামর্শ ও অবহিতকরণ সভার আয়োজন করবে ডিএসসিসি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করা হবে।
চলতি মাসে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে জরিপ চালানো শুরু করেছে ডিএসসিসি। মশকনিধনকর্মী, চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এই মাসে কীটনাশক ও যন্ত্র সংগ্রহ, প্রচারপত্র ও স্টিকার বিতরণের কাজ শুরু করবে ডিএসসিসি।
চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাধ্যমে নিবিড় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে ডিএসসিসি। কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক ও ওয়ার্ড এই তিন পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক সভা করবে ডিএসসিসি। এর মধ্যে প্রতি ওয়ার্ডে প্রতি সপ্তাহে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভা করা হবে। আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতি মাসে ন্যূনতম তিনটি প্রতিষ্ঠানে সভা এবং মার্চ, জুন ও সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সভা করার পরিকল্পনা করেছে ডিএসসিসি।
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়ার্ডভিত্তিক শোভাযাত্রা, মে মাসে অঞ্চলভিত্তিক এবং এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয়ভাবে সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা করার পরিকল্পনা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসে সপ্তাহের সাত দিন ওয়ার্ডভিত্তিক মাইকিং করা হবে। আর প্রচারপত্র বিতরণ ও গণপরিবহনে স্টিকার লাগানোর কার্যক্রম চলবে বছরব্যাপী।
চলতি মাসে প্রতি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ১৫টি বাড়ি, মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরে প্রতি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ৫০টি বাড়ি এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ওয়ার্ডে প্রতিদিন ১৫টি বাড়িতে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রম চলবে। বছরজুড়ে চলবে কীটনাশক দেয়ার রুটিন কার্যক্রম। আর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে এই কার্যক্রম জোরদার করা হবে। এপ্রিল, জুন ও আগস্টে সপ্তাহব্যাপী কীটনাশক প্রয়োগের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করা হবে।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনা থাকায় কোন সময়ে কী কাজ হবে, তা নির্ধারিত থাকছে। সময় অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় করতে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। ডেঙ্গুর মৌসুমে চিরুনি অভিযানের আদলে অভিযান চলবে।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির বছরব্যাপী কার্যক্রমকে তিনটি সময়ে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলোÑ প্রাক-মৌসুম কার্যক্রম (জানুয়ারি-মার্চ), মৌসুমের কার্যক্রম (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) এবং মৌসুম-পরবর্তী কার্যক্রম (অক্টোবর-ডিসেম্বর)। প্রাক-মৌসুম কার্যক্রমের মধ্যে আছে মশার উৎপত্তিস্থল হিসেবে নালা, খাল, জলাশয়, মজা পুকুর থেকে কচুরিপানাসহ অন্যান্য ময়লা পরিষ্কার করা। মাঠপর্যায়ে কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে অবহিত করা। কীটনাশক, মশার জন্মস্থান ব্যবস্থাপনায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যাডভোকেসি সভার আয়োজন করা।
ডিএনসিসির ২৮৫ জন নিজস্ব মশকনিধনকর্মী আছে। ডেঙ্গুর মৌসুমে নিজস্ব কর্মীদের পাশাপাশি ওয়ার্ড পর্যায়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করা ১০ জন মশকনিধনকর্মীর মধ্যে পাঁচজন ফগার ও স্প্রে মেশিনের সাহায্যে মশার লার্ভা ও উড়ন্ত মশা নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। বাকি পাঁচজন এডিস ও কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
ডেঙ্গুর মৌসুমে বাস টার্মিনাল ও বাস ডিপো, পরিত্যক্ত টায়ার, নির্মাণাধীন বাড়ি, মেট্রোরেল প্রকল্প, চিড়িয়াখানা, সরকারি প্রতিষ্ঠান, থানার পরিত্যক্ত গাড়ি ইত্যাদি স্থান ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের নেতৃত্বে গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী, মসজিদের ইমাম, বাড়ি মালিক সমিতির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমপক্ষে একটি অ্যাডভোকেসি সভার আয়োজন করার পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ইমামদের মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসংক্রান্ত বার্তা প্রচার করা হবে।
শুরুতেই যন্ত্রে গোলযোগ নেই প্রশিক্ষিত কর্মী
এডিস ও কিউলেক্স মশানিধনে এ বছর প্রথমবার বিশেষ কর্মসূচি শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তবে কর্মসূচির শুরুতেই মশামারা যন্ত্রে গোলযোগ দেখা দেয়। দুটি ভেহিক্যাল মাউন্টেন্ড ফগার যন্ত্রের একটি চলেনি। যন্ত্রের চালকেরও প্রশিক্ষণ ছিল না। দু’টি যন্ত্রেরই নল থেকে ধোঁয়া বের না হয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হতে দেখা যায়।
গত শনিবার সকালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর-১৩ নম্বরের পুলিশ স্টাফ কলেজ এলাকায় মশকনিধনের এ বিশেষ কর্মসূচি শুরু হয়। উদ্বোধন করেন ডিএনসিসির প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা। সকালে ভেহিক্যাল মাউন্টেন্ড ফগার যন্ত্র দুটি চালু করতে গেলে গোলযোগ দেখা দেয়। এর একটির ব্যারেলের (নলের) মুখ থেকে আগুনের শিখা বের হয়।
জানা গেছে, এই বিশেষ কর্মসূচিতে মশা নিয়ন্ত্রণে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নতুন করে ১০ জন কর্মী কাজ করবেন। তাদের পাঁচজন নিয়মিত লার্ভিসাইডিং ও ফগিং কার্যক্রমে এবং অন্য পাঁচ কর্মী নিয়মিত কর্মীদের সাথে এডিস ও কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল (হট স্পট) চিহ্নিত ও ধ্বংস করবেন।
ঘটনাস্থলে থাকা গণমাধ্যমকর্মীরা এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি যন্ত্রটির স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ। যিনি এ যন্ত্র চালাচ্ছিলেন, তিনি এ কাজে প্রশিক্ষিত নন। সে কারণে ঠিকমতো চালাতে না পারায় এমন ঘটনা ঘটেছে। যন্ত্রগুলোর ওয়ারেন্টি আছে। কোনো গোলযোগ দেখা দিলে যাদের কাছ থেকে কেনা হয়েছে, তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে।
যন্ত্র দু’টি চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত এক মশকনিধনকর্মী বলেন, এসব যন্ত্র ব্যবহারে তার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। এ কারণে তিনি জানেন না কী সমস্যার কারণে যন্ত্র চলছে না বা আগুন জ্বলেছে।
ডিএনসিসির নিয়মিত কর্মসূচিতে মশা কমছে না বলে অভিযোগ এলাকার মানুষের। এডিস ও কিউলেক্স মশা বেড়েছে মেনে নিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সপ্তাহব্যাপী ‘বিশেষ মশকনিধন কর্মসূচি’ শুরু করেছে সংস্থাটি। এ কর্মসূচি চলবে ২৮ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত। ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে চলবে এই কর্মসূচি। ছবি : আর্কাইভ