ছুটির দিনে জমজমাট বাণিজ্যমেলা
- মাহমুদুল হাসান
- ২১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
ছুটির দিনে সকাল থেকেই ক্রেতা-দর্শকরা আসতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ক্রেতা-দর্শকদের সমাগমও বাড়ে। বিকেলের পর মেলা মাঠ ভরে ওঠে কানায় কানায়। বলা যায়, তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। অনুকূল পরিবেশ ও বন্ধের দিন হওয়ায় গত শুক্রবার মেলার মাঠে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। মেলা ঘুরে লিখেছেন মাহমুদুল হাসান
জানুয়ারির শুরুতে মেঘলা আকাশ আর উত্তুরে বাতাসের সম্মিলনে কনকনে শীত বয়ে গেছে দেশব্যাপী। রাজধানী ঢাকাও তার বাইরে ছিল না। গত শুক্রবার ছুটির দিনের আকাশে সূর্য হেসেছে। তাপমাত্রাও বেড়েছে কিছুটা। দিনভর রোদের ঝিলিক ছিল সর্বত্র। অনুকূল আবহাওয়া পেয়ে ব্যাপক ক্রেতা-দর্শকের সমাগম হয়েছিল বাণিজ্যমেলায়। দিনে শেষেও রোদমাখা হাসি ছিল ব্যবসায়ীদের মুখে।
গত শুক্রবার মেলার ৩৫টি কাউন্টার থেকে টিকিট সরবরাহ করার পরও দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছে। কাউন্টারের বাইরেও টিকিট সরবরাহ করেছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবাদাতা কোম্পানি বিকাশ। সংস্থাটি অ্যাকাউন্ট খোলার শর্তে বিনামূল্যে টিকিট সরবরাহ করেছে।
মেলা শুরুর পর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত তিনটি শুক্রবার গেছে। ৩ জানুয়ারি প্রথম শুক্রবার ব্যাপক ঠাণ্ডা ছিল। আবার ওই সময় মেলাও ছিল কিছুটা অগোছালো। পরের শুক্রবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা অনুষ্ঠানের জন্য মেলা ছিল বন্ধ। ফলে মেলা শুরুর পর শুক্রবারই প্রথম ক্রেতা-দর্শনার্থীরা অনেকে এসেছেন মেলায় বেড়াতে। অনেকে এসেছেন কেনাকাটা করতে। একসাথে দুটোই সেরে নেয়ার লোকও কম নয়। ছেলে-বুড়ো, তরুণ-তরুণীরা, বন্ধু-বান্ধব ও সপরিবারে মেলায় ঘুরেছেন। খাওয়ার হোটেলগুলোতে দুপুরের পর থেকে বসার জায়গা ছিল না। প্রতিটি প্যাভিলিয়ন, স্টল ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। এমনকি এটিএম বুথে লাইন দিয়ে টাকা তুলেছেন অনেকে। অনেকে বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়েছেন। মেলায় আসা ক্রেতা-দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জায়গায় লোকজনের সঙ্কুলান হয়নি। অনেকে বাধ্য হয়েছে মেলা প্রাঙ্গণে তৈরি ফুলের বাগানগুলোর দেয়ালে, অনেকে কোনো কোনো প্যাভিলিয়ন বা স্টলের সামনের খালি জায়গায় বসে বিশ্রাম নিয়েছেন। অনেকে মেলায় ঘুরে ঘুরে ছবি তুলেছেন। দূরে থাকা বন্ধুদের মেলার স্বাদ দিতে ফেসবুক লাইভও করতে দেখা গেছে কয়েকজনকে।
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য দিনের তুলনায় বেচাকেনা বেশি। বেশির ভাগেরই কিছু না কিছু কিনেছেন। অনেককে দেখা গেছে দুই হাতে একাধিক ব্যাগভর্তি পণ্য কিনে ফিরছেন। শীত কমলেও গরম কাপড়ের বিশেষ করে শাল, ব্লেজারের স্টলগুলোতে ব্যাপক ভিড় ছিল। কাশ্মিরি শাল নামে যেসব শাল বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর স্টলে নারী ক্রেতাদের বেশি দেখা গেছে। আবার পুরুষদের দেখা গেছে ব্লেজারের স্টলগুলোতে। এ ছাড়া গৃহস্থালি পণ্য, আসবাবপত্র, মসলা, ভোগ্যপণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, ইমিটেশন গয়নার স্টলগুলোতে বেশি ভিড় দেখা গেছে। ঠাণ্ডার দিন হলেও শুক্রবার আইসক্রিমের দোকানে ভিড় ছিল বেশি।
প্রযুক্তির কল্যাণে কাঠ, প্লাস্টিক কিংবা অ্যালুমিনিয়ামের পরিবর্তে পাট দিয়েই তৈরি হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন চেয়ার-টেবিল, ঢেউটিন, প্লেনশিট, ঘরের দরজা-জানালা থেকে শুরু করে বেসিন, ট্রে, হার্ডবোর্ড, হেলমেট প্রভৃতি। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার ৪ নম্বর মিনি প্যাভিলিয়নে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের উদ্ভাবিত পাটের এসব পণ্য প্রদর্শিত ও বিক্রি হচ্ছে। ব্যতিক্রমী এসব পণ্য বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছেন ক্রেতারা। তবে দাম শুনেই অনেকে ফিরে যাচ্ছেন।
প্যাভিলিনের বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ছোট আকারের প্রতিটি ট্রে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়, বড় ট্রে ৫০০ টাকা। একই মাপের প্লাস্টিকের ট্রে অন্য স্টলে পাওয়া যাচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। প্রতি হার্ডবোর্ড বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। অথচ এ ধরনের প্লাস্টিকের বোর্ড বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকায়। এ ছাড়া কাঠের চেয়ারের তুলনায় অনেক বেশি দামে পাটের চেয়ার বিক্রি হচ্ছে। ছোট সাইজের একটি ডাইনিং টেবিল নিচ্ছে ছয় হাজার টাকা।
মাসব্যাপী চলমান বাণিজ্যমেলায় বাংলাদেশসহ ২১টি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৪৮৩টি প্যাভিলিয়ন ও স্টল থাকার তথ্য দিয়েছে আয়োজক প্রতিষ্ঠান রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এর মধ্যে প্রিমিয়ার প্যাভিলিয়ন ৬৪টি, সাধারণ প্যাভিলিয়ন ১৩টি, সাধারণ মিনি প্যাভিলিয়ন ৫৯টি, প্রিমিয়াম মিনি প্যাভিলিয়ন ৪২টি রাখা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে রেস্তোরাঁ আছে দু’টি, স্ন্যাকস বুথ সাতটি, প্রিমিয়ার স্টল ৮৪টি, সংরক্ষিত প্যাভিলিয়ন ছয়টি, সংরক্ষিত মিনি প্যাভিলিয়ন আটটি, সাধারণ স্টল ১০৭টি, ফুড স্টল ৩৫টি। পাশাপাশি বিদেশী প্যাভিলিয়ন ২৭টি, বিদেশী মিনি প্যাভিলিয়ন ১১টি ও বিদেশী প্রিমিয়াম স্টল ১৭টি রয়েছে।
মেলায় দেশীয় বস্ত্র, মেশিনারিজ, কার্পেট, কসমেটিক্স অ্যান্ড বিউটি এইডস, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস, পাট ও পাটজাত পণ্যসামগ্রী, চামড়া/আর্টিফিশিয়াল চামড়া ও জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য, স্পোর্টস গুডস, স্যানিটারিওয়্যার, খেলনা, স্টেশনারি, ক্রোকারিজ, প্লাস্টিকসামগ্রী, মেলামাইনসামগ্রী, হারবাল ও টয়লেট্রিজ, ঘড়ি, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ইমিটেশন জুয়েলারি, সিরামিকস, টেবলওয়্যার, ক্যাবল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ফাস্টফুড, আসবাবপত্র ও হস্তশিল্পজাত পণ্য, উপহারসামগ্রী, কনস্ট্রাকশনসামগ্রী, হোম ডেকর, বেকারি পণ্য, বিদেশী বস্ত্র ইত্যাদি পণ্য রয়েছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ
এবার ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় ক্রেতারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কাছে অভিযোগ করেছেন। দাম বেশি নেয়া, পণ্যের গায়ে মূল্য তালিকা, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ না থাকায় তারা অভিযোগগুলো করেন।
এর মধ্যে কিছু অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। বাকি অভিযোগের মধ্যে কিছু সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (মেট্রো) মো: মাগফুর রহমান জানিয়েছেন, মেলায় এস এস ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে মো: রকিবুল হাসান নামের এক ভোক্তা অভিযোগ করেন। তার অভিযোগ ছিল ‘পণ্যের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পরিবর্তন করে নতুন মেয়াদ দেয়া হয়েছে।’ এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
মাগফুর রহমান বলেন, ভোক্তাদের অভিযোগের পাশাপাশি আমরা নিজেরাও মেলা প্রাঙ্গণে অভিযান চালাচ্ছি। অভিযানে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ফ্রি চিকিৎসা দিচ্ছে ইবনে সিনা
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় আগত ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ফ্রি চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা। মেলার ১০ নম্বর প্রিমিয়ার মিনি প্যাভিলিয়নে ইবনে সিনার ন্যাচারাল ওষুধ বিক্রয় ও প্রদর্শনী হচ্ছে। মেলায় আগত ক্রেতা-দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠানটি ফ্রি চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি তাদের ওষুধে ও বিভিন্ন পণ্যে দিচ্ছে বিশেষ মূল্য ছাড়। মেলায় ইবনে সিনার প্যাভিলিয়নে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সের দর্শনার্থী চিকিৎসা নিতে বসে আছেন। চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন অভিজ্ঞ তিনজন ন্যাচারাল মেডিসিন চিকিৎসক।