বছরজুড়ে আলোচিত ডেঙ্গু, ওয়াসার পানি ও বায়ুদূষণ
- মাহমুদুল হাসান
- ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
২০১৯ সালে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। সরকারি ঘোষণা না এলেও কেউ কেউ বলেছেন, এটা মহামারী। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ওঠে গাফিলতির অভিযোগ। ওষুধ আনা নিয়েও হয় ঠেলাঠেলি। অবশেষে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ডেকে করণীয় ঠিক করে দেন উচ্চ আদালত।
বছরের শুরুতে কিছুটা ঝিম মেরে থাকলেও জুন মাস থেকে একচেটিয়া ‘দাপট’ দেখিয়েছে এডিস মশা। এডিস মশাকে বাগে আনতে ঢাকাসহ দেশের ১১টি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে ঘাম ঝরাতে হয়েছে। অথচ বছরের শুরুতেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিফতর। কিন্তু তা আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দফতরগুলো। এরই মধ্যে মশার ওষুধ কেনা নিয়ে নয়ছয়ের বিষয়টিও সামনে আসে। এডিস মশার বিস্তার রোধে বছরজুড়ে পরিকল্পনা করে সেই মতো কার্যক্রম চালানোর দাবি ওঠে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয় এবং জনগণকে সাথে নিয়ে রীতিমতো এডিসের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ই ঘোষণা করে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি এতটাই ব্যাপকতার দিকে যায়, ছোট এই প্রাণীটি পরিণত হয় আতঙ্কে। জুন মাস থেকে ক্রমান্বয়েই বাড়তে থাকে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর ব্যাপকতা। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অতীতের যেকোনো রেকর্ড ছাড়ায়।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে ২৬৬টি মৃত্যুর তথ্য পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২৩৪টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে ১৪৮টি মৃত্যু ডেঙ্গুজনিত বলে নিশ্চিত করেছে প্রতিষ্ঠানের ডেথ রিভিউ কমিটি। তবে বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা প্রায় ৩০০।
সরকারের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ না জানালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর কারণে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আক্রান্তদের চিকিৎসা, রোগীদের সাথে হাসপাতালে অবস্থানকারীদের জন্য খরচ ও তাদের কর্মঘণ্টার হিসাব করা হয়েছে। তবে যারা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন তাদের খরচ এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ জানিয়েছেন, সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ সমীক্ষা করে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। যারা মারা গেছেন তাদের জীবনের মূল্য তো আর্থিকভাবে হিসাব করা যাবে না। কিন্তু মাথাপিছু আয় বিবেচনা করে তাদের গড় বয়সের হিসেবে আর্থিক ক্ষতিটা তুলে ধরা হয়েছে। এ গবেষণায় প্রাপ্ত আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আদর্শ ধরা ঠিক হবে না। তা ছাড়া এই সমীক্ষা মূলত কাউকে দোষারোপ করার জন্য নয়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বছরব্যাপী কার্যক্রম আছে বলে জানান অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা: সানিয়া তাহমিনা। তিনি বলেন, এবার বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপের কথা জানিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে আগেভাগেই সতর্ক করা হয়েছিল। ফেব্র“য়ারি থেকে চিকিৎসকদের সতর্ক করা হয়েছিল, যাতে তারা ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে পারেন। এরপর মার্চে ঢাকায় এডিস মশার বিষয়ে জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তখনই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রাণঘাতী এই রোগ ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে সে কথাও জানানো হয়েছিল। এই আশঙ্কা থেকেই আমরা গাইডলাইন আপডেট করেছি।
রোগতত্ত্ব, রোগ-নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা: মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, মৌসুম ছাড়া এখন অন্য সময়েও মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। সে জন্য বছরব্যাপী নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে না গেলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রধান কাজ হলো মশার উৎস নির্মূল করা। ডেঙ্গু এখন ‘ওয়ান টাইম ইস্যু’ নয়।
ওয়াসার নোংরা পানি
রাজধানীবাসীর জন্য সুপেয় পানির একমাত্র জোগানদাতা ওয়াসা। ঢাকা ওয়াসার পানিতে দূষণও আলোচনায় বছরজুড়েই। ওয়াসার দাবি, তাদের দেয়া পানি শতভাগ বিশুদ্ধ। বিষয়টি গড়ায় আদালতে পরীক্ষায় মেলে নোংরা পানির প্রমাণ। কিন্তু, তাতেও ওয়াসাকে অতটা উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।
একটি কাচের জগে পানি, এক কেজি চিনি, কয়েকটি লেবু আর ছুরি নিয়ে কারওয়ান বাজারের ওয়াসা ভবনে হাজির হয়েছিলেন মিজানুর রহমান, মাসুরা আহমেদ শুচিসহ জুরাইনের কয়েকজন বাসিন্দা। উদ্দেশ্য ছিল ওয়াসার এমডিকে তার ভাষা অনুযায়ী ‘সুপেয় পানি’র শরবত বানিয়ে খাওয়াবেন। বিষয়টি রাজধানীবাসীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
রাজধানীতে সরবরাহ করা ওয়াসার পানি সুপেয়Ñ সংস্থাটির এমন দাবি অসত্য। ওয়াসার পানিতে মিলেছে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও মলের জীবাণু। গত ২ ডিসেম্বর হাইকোর্টে দেয়া বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সুপেয় পানি নিশ্চিতে ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করার সুপারিশ করেছে বিশেষজ্ঞ কমিটি।
প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের সরবরাহ করা পানি সুপেয়। কিন্তু গত জুলাইয়ে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিটি জানায়, তাদের সরবরাহ করা পানিতে মিলেছে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও মলের জীবাণু। কিন্তু তা মানতে চায়নি ওয়াসা। এমন বাস্তবতায় আরেকটি বিশেষজ্ঞ কমিটিকে পানি পরীক্ষায় দায়িত্ব দেন হাইকোর্ট। সেই প্রতিবেদন বলছে, ওয়াসার দাবি ঠিক নয়। একাধিক জায়গা থেকে পানির নমুনা জোগাড় করে পরীক্ষা করে এই কমিটি। যাতে ক্ষতিকর ই-কোলাই ও ব্যাকটেরিয়া পাওয়ার সত্যতা মিলেছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নুর উস সাদিক জানান, বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের প্রতিবেদনে চারটি মন্তব্য তুলে ধরে। যাতে বলা হয়েছে, ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশন সমন্বিতভাবে কাজ করলে, ওয়াসার লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যাকটেরিয়া কিংবা জীবাণু ঢুকত না।
সুপেয় পানির জন্য তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে নজরদারি করা, সচেতনাতামূলক কার্যক্রম চালানো ও বাসাবাড়ির রিজার্ভ ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার রাখার সুপারিশও করা হয় প্রতিবেদনে। সেইসাথে তাগিদ দেন সব ধরনের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার। রিটকারী আইনজীবী তানভীর আহমেদ বলছেন, তারা চান সারা বছর যেন এ মামলাটি মনিটরিং করা হয়।
বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা
বায়ুদূষণ সূচকে ভারতের রাজধানী দিল্লিকে ছাড়িয়েছে ঢাকা। বাতাসের মান নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজুয়ালের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় গত ১৯ নভেম্বর ১ নম্বরে চলে যায় ঢাকা। এয়ার ভিজুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ২১২, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। আর দিল্লির স্কোর ১৯৬, যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে।
প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে তা জানায়। একিউআই সূচকে ৫১ থেকে ১০০ স্কোর পাওয়ার মানে হলো বাতাসের মান গ্রহণযোগ্য। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর পাওয়ার অর্থ হচ্ছে বাতাসের মান দূষিত। দীর্ঘ দিন ধরেই দূষিত বাতাস নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা। নভেম্বরে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ২১২, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর।
বায়ুদূষণে গত ১৫ ডিসেম্বর সকালেও শীর্ষে অবস্থান করছিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। বিশ্বের দূষিত সব শহরকে পেছনে ফেলে আজ সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকা শীর্ষে চলে যায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এয়ার ভিজুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় এ সময় বায়ুদূষণের পরিমাণ ছিল ২৩৭ পিএম। ২৩৬ পিএম নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল মঙ্গোলিয়ার উলানবাটোর। ১৯৭ পিএম নিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল তৃতীয়, ১৯১ পিএম নিয়ে পাকিস্তানের লাহোর চতুর্থ, ১৮৩ পিএম নিয়ে চীনের চেংদু পঞ্চম এবং ১৮২ পিএম নিয়ে ষষ্ঠ ছিল ভারতের দিল্লি।