২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মশকনিধন কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে

-

এডিস মশার কারণে কয়েক মাস আগে প্রায় মহামারী আকার নিয়েছিল ডেঙ্গু জ্বরে। সারা দেশে এই জ্বরে প্রাণ গেছে কয়েক শ’ মানুষের, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে হাজার হাজার জনকে। বছরখানেক আগে একই অবস্থা হয়েছিল চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে। এবার ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবের সময় তুমুল সমালোচনা ও চাপের মুখে কিছুটা গতি পেয়েছিল সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম। ডেঙ্গুর সেই প্রাদুর্ভাব এখনো নির্মূল না হলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মনে করছে, আপাতত মশা আর কোনো সমস্যা নয়। এ কারণে তাদের মশকনিধন কার্যক্রমেও ভাটা পড়েছে।
অথচ প্রতিদিনই মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হচ্ছেন নগরবাসী। গত কয়েক দিনে মশার অত্যাচার অনেক বেড়েছে। পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে শঙ্কায় দিনরাত পার করছেন বাসিন্দারা।
রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা সাবেরা সুলতানা জানান, পাঁচতলার ওপর থেকেও মশার যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। অ্যাডিশ মশার কারণে পরিবার নিয়ে বিশেষ করে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে খুব ভয়ে আছেন। মগবাজার এলাকায় কয়েকজন কিছু দিন আগেও এডিস মশার কামড় খেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ জন্য তারাও ভয়ে আছেন। প্রতিদিন বিকেল হতেই বাসায় মশার কয়েল জ্বালিয়ে রাখছেন।
পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা রুবেল আহমেদ জানান, অন্য বছর এই সময়ে মশা কম থাকে। এবার কমছে না। ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের সময় কিছু দিন ওষুধ ছিটাতে দেখেছিলেন। এখন আর সেটা নেই।
কেবল মগবাজার, শেওড়াপাড়া এলাকাই নয়, রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, তেজগাঁও, রামপুরা, ধানমন্ডি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকাসহ নগরীর প্রতিটি এলাকার বাসিন্দা মশার আতঙ্কে ভুগছেন। ভিআইপি এলাকার বাসিন্দাদের ভয় আরো বেশি। কারণ এডিস মশার বিস্তার বনেদি এলাকাতেই বেশি ঘটে।
রাজধানীতে মশার উপদ্রব সহনীয় রাখতে ও এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে বদ্ধ জলাশয় ও নর্দমা পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, সচেতনতামূলক কর্মসূচিসহ যেসব কার্যক্রম চলমান রাখা প্রয়োজন, বর্তমানে দুই সিটি করপোরেশনই তা থেকে অনেকটা বিরত রয়েছে। ফলে রাজধানীতে দেখা দিয়েছে মশার দৌরাত্ম্য। রয়েছে এডিস মশার উপস্থিতিও। বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাধীন থাকার খবরও পাওয়া যাচ্ছে মাঝে মধ্যেই। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এডিস মশার প্রাদুর্ভাবকালে কিছু পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি গ্রহণ করলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। ওই সময় মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা গেলেও এখন আর ফগারম্যানদের দেখা মিলছে না।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশ্বাস, শীতের তীব্রতা বাড়লে মশার দৌরাত্ম্য এমনিতেই কমে যাবে। মশারও মৃত্যু ঘটবে। এ জন্য ওষুধ ছিটানোর ব্যাপারে তারা অনেকটাই নিস্পৃহ। এমনকি গত ২০ আগস্ট মশকনিধন দিবসেও দুই সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মসূচি ছিল না। কেবল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন একটি পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। আর কোনো সংস্থার কোনো কর্মসূচি ছিল না। মূলত এসব উদাসীনতার সুযোগে রাজধানীতে আবারো বেড়েছে মশার যন্ত্রণা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা কিছু করছেন না, এটা ঠিক নয়। নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডকে কয়েক ভাগে ভাগ করে মশকবিরোধী অভিযান চলছে। পাশাপাশি নতুন ওয়ার্ডগুলোতে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হয়েছে। মশাও নিয়ন্ত্রণে আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা: এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এই সময়ে কিউলেক্স মশা বেড়ে যায়। খাল-জলাশয়-নালা ও ড্রেনগুলো মশার উৎকৃষ্ট প্রজননস্থলে পরিণত হয়। বৃষ্টি না থাকায় এসব জায়গায় পানিপ্রবাহ থাকে না। তখন মশার বংশবিস্তার সহজ হয়। এ জন্য ওই সব স্থানে বেশি করে মশার ওষুধ ছিটানো প্রয়োজন। পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। মনে হয় এ দিকে একটু ঘাটতি আছে।

সারা বছর মশা মারার নির্দেশ

ডিসেম্বর মাসেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বছরই কমবেশি ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে। কিন্তু মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সরকারি সংস্থাগুলোর গা ছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বছরব্যাপী মশকনিধন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। গত ১২ ডিসেম্বর এক চিঠিতে মশকনিধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। বছরব্যাপী মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ নিয়ে গত রোববার স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মৌসুম ছাড়া এখন অন্য সময়েও ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকছে। সে জন্য বছরব্যাপী নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার।
গত তিন বছরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গু কমবেশি সারা বছরই ছিল। তবে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় জুলাইয়ের শুরুতে ঢাকায় ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আগস্টের মাঝামাঝি ঈদুল আজহার ছুটির সময় ঢাকা থেকে যাওয়া মানুষের সাথে সব জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে তৎপর হয়। দুই বেলা ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা হয়। বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান চালানো হয়। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রমে যে গতি ছিল, তা এখন অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে।
রাজধানীর বাসিন্দারা বলছেন, প্রকোপ শুরুর পর মাঝখানে কিছু দিন প্রায় নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো হতো। তবে কিছু দিন ধরে ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম প্রায় স্তিমিত হয়ে এসেছে। মশকনিধনকর্মীদের আগের মতো ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না। ঢিমেতালে কাজ করছেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। এ সুযোগে কিউলেক্স মশার উপদ্রবও বেড়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, মশকনিধনে বছরব্যাপী একটি কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে সেগুলো ধ্বংসের কাজ চলছে। খালগুলো মশার বড় প্রজননক্ষেত্র। খাল পরিষ্কারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মশকনিধনে সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটে, এ সময়কে ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম বলা হয়। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গত তিন বছরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, কমবেশি সারা বছরই ডেঙ্গু ছিল। আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। গত রোববার ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১০৯ জন।
এমন পরিস্থিতিতে ১২ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের সিটি করপোরেশন-১ শাখা থেকে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের চিঠি পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, সিটি করপোরেশনগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালনা না করায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আবার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এডিস মশার পাশাপাশি কিউলেক্স মশার প্রকোপও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও সংস্থাগুলোর মধ্যে পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক তথ্য আদান-প্রদানে হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খোলা হয়েছে। মশকনিধন কার্যক্রমের তথ্য ও ছবি প্রতিদিন এই গ্রুপে দাখিল করতেও নির্দেশ দেয়া হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় এ বছর শীতেও ডেঙ্গু আছে। এডিস ও কিউলেক্স মশা নিধনের জন্য আলাদা আলাদা কর্মসূচি বছরব্যাপী চালাতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement