২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঢাকা ওয়াসার দূষিত পানিতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে

ছবি : আর্কাইভ -

বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। ২০১০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার বিষয়ে সরকার ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি। কয়েক বছর ধরে রাজধানীবাসীর জন্য সুপেয় পানির জোগানদাতা ঢাকা ওয়াসার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। নগরবাসীর অভিযোগ, ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা পাওয়া যায়। দীর্ঘ সময় ফোটানোর পরও কিছু কিছু এলাকার পানি থেকে দুর্গন্ধ দূর হয় না। ওই পানি পুরোপুরি পানের অযোগ্য।
ঢাকা ওয়াসার দূষিত পানি পান করে লাখ লাখ মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা অধিক হারে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দূষিত পানি পানের কারণে মানুষ ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভারসহ নানা জটিল ও প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে প্রতি পাঁচজনে তিনজন নিরাপদ খাবার পানি পায় না। স্বল্পমাত্রায় পানি সরবরাহ ও অপ্রতুল স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এসব দেশে ৮০ শতাংশ রোগব্যাধি হয়ে থাকে।
জাতিসঙ্ঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রামাঞ্চলে শতকরা ৮৭ শতাংশ মানুষের পানীয় ও সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। এ জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি পাঁচটি রোগের মধ্যে চারটিই সৃষ্টি হয় বিশুদ্ধ পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব থেকে। তাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ২৫ হাজার মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কেবল বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন পানি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পানিবাহিত রোগ এবং এ কারণে মৃত্যুঝুঁকি প্রায় ২১ শতাংশ পর্যন্ত কমানো যেতে পারে বলে মত দিয়েছে সংস্থাটি।
সুপেয় পানির দাবিতে আন্দোলন, এমনকি ওয়াসা ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করেছে রাজধানীবাসী। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল; রাজধানীতে সরবরাহ করা ওয়াসার পানি সুপেয়। এরপর গত জুলাইয়ে হাইকোর্ট ওয়াসার পানির মান পরীক্ষার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। ওই কমিটি গত সোমবার আদালতে ওয়াসার পানির মান-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই প্রতিবেদন বলছে, ওয়াসার দাবি ঠিক নয়। একাধিক জায়গা থেকে পানির নমুনা পরীক্ষা করে এই কমিটি। এতে ক্ষতিকর ই-কোলাই ও ব্যাকটেরিয়ার সত্যতা মিলেছে। আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করার কথা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বছরে আড়াই কোটি মানুষ পানিবাহিত রোগের কারণে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন ১০ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি রয়েছে। রাজধানীতে প্রতিদিন ২২০ থেকে ৩০০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন। গত তিন দশকে ভূগর্ভস্থ পানির জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। বর্তমানে সারা দেশে বছরে প্রায় তিন কোটি ২০ লাখ মানুষ পানি সঙ্কটে ভুগছে।
দেশে মানুষের প্রতিদিন সুপেয় পানির যে চাহিদা রয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সেই চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়। অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে প্রতি বছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। পানির স্তর নিচে নামার সাথে সাথে ভূগর্ভস্থ খাবার পানির সাথে নলকূপে উঠে আসছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও দূষিত পদার্থ। সর্বত্র ভূগর্ভস্থ পানি না পাওয়ায় মানুষকে ভূ-উপরিভাগের পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। গ্রামের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী বিকল্প হিসেবে নদ-নদী, পুকুর, খাল-বিলের পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ওই পানি ব্যবহারযোগ্য নয়। এসব পানি পান করে বিভিন্ন রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা: মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও নগরায়নের ফলে আবাসিক এলাকা, শিল্পকারখানা ও পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্র বাড়ছে। এ ছাড়া শহরাঞ্চলের বস্তি এলাকা ও গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো খোলা পায়খানা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব পানিতে মিশে পানি দূষিত করছে। শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য পদার্থ, বিভিন্ন নৌযান থেকে তৈলাক্ত পদার্থ, দস্তা, ক্রোমিয়ামসহ নানা দূষিত পদার্থ পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে ভূপৃষ্ঠের উপরি ভাগের পানি দূষিত হচ্ছে। এতে করে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের আইইডিসিআর ও সিডিসি প্রোগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, পানি প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়নের ফলে আবাসিক এলাকা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা, পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। তেলের ট্যাঙ্কারের মতো উৎস থেকেও প্রচুর ধাতু, তৈলাক্ত পদার্থ, সিসা, পারদ, দস্তা ও ক্রোমিয়ামের মতো বিষাক্ত দ্রব্য নদ-নদী ও সাগরের পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। গত কয়েক বছর বস্ত্র শিল্প, চামড়া শিল্প, শোধনাগার, ছাপাখানা ও বড় শিল্পের তরল বর্জ্য দূষণের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে ভূপৃষ্ঠের পানি দূষণ সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়ে গ্রামের মানুষ যখন নলকূপের পানির ব্যবহার শুরু করে, তখনই তারা আর্সেনিকের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে ভূপৃষ্ঠের উপরি ভাগের পানি দূষিত হয়। এই কীটনাশকে নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস থাকে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তা মাটির ভেতরে পানিকে বিষাক্ত করে।
পানিবাহিত রোগ ডায়ারিয়া মোকাবেলায় বিশুদ্ধ পানি পানের বিকল্প নেই। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে পানির চাহিদা অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী পানি না পেয়ে বেশির ভাগ মানুষই জীবাণুযুক্ত ও দূষিত পানি পান করে। এই দূষিত পানির মাধ্যমেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি জন্ডিসের জীবাণুও ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন, আইসিডিডিআরবি ডায়রিয়া ডিজিজ ইউনিটের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: আজহারুল ইসলাম।
পানিতে মিশে থাকা কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসা, ক্যাডমিয়ামসহ বিভিন্ন দূষিত পদার্থ শুধু ফোটানোর মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়। পানিতে কোন পদার্থ মিশে আছে আগে তা শনাক্ত করতে হবে। এরপর পৃথকভাবে পরিশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। জীবাণুভেদে পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য পৃথক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয়।
পানিতে মিশে থাকা বিষাক্ত কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসাসহ বিভিন্ন দূষিত পদার্থ কেবল ফোটানোর মাধ্যমে দূর করা যায় না। ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংসের জন্য পানি সঠিক মাত্রায় ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ফোটাতে হয়। কিন্তু সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে পানি ফোটানোর বিষয়টি সবার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই পানি ফোটালেও ঝুঁকি থেকে যায়। ফোটানোর পর পানি থেকে ব্যাকটেরিয়া দূর হলেও ক্লোরিনের পরিমাণ কমে না। এমনকি পাত্রে রাখা ফোটানো পানিতে আবার ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে। তাই ফোটানো ছাড়াও বিভিন্নভাবে পানি বিশুদ্ধ করা যায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement